এলাকারই খাদান ও ক্রাশার থেকে পাথর নিয়ে গিয়ে অন্যত্র তৈরি হচ্ছে রাস্তা। বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন শহরে। অথচ সেই এলাকার নিজের রাস্তারই অবস্থা সব থেকে ভয়ঙ্কর। অভিযোগ, ঠিকাদার লাগিয়ে লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করে কয়েক বার ‘তাপ্পি’ মারা হয়েছে বটে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ফের নিজের পুরনো চেহারায় ফিরে আসে মহম্মদবাজারের সোঁতশাল মোড় থেকে ঢোলকাটা পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারের এই পথটি।
তাই ৬০ নম্বর রানিগঞ্জ-মোরগ্রাম জাতীয় সড়কে এসে মেশা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পে তৈরি হওয়া ওই রাস্তা সংস্কারের দাবিতে বারবারই অবরোধের মতো কর্মসূচি নিতে বাধ্য হন পাঁচামি পাথর শিল্পাঞ্চলের ক্ষুব্ধ মানুষ।
মহম্মদবাজারের পাঁচামি ও তালবাঁধ মূলত পাথর শিল্পাঞ্চল। সেখানে ওই রাস্তাটি এলাকার ‘লাইফ লাইন’ই বলা চলে। রাস্তাটা দিয়ে রোজ গড়ে হাজার দু’য়েক পাথর ভর্তি ট্রাক চলাচল করে। তার বাইরে সাধারণ যানবাহন তো রয়েইছে। রাস্তাটি পাঁচামি পর্যন্ত পূর্ত দফতরের অধীন। বাকি অংশের দেখভালের দায়িত্ব বীরভূম জেলা পরিষদের। ওই অংশেরই অবস্থা সব থেকে খারাপ। বছর দেড়েক আগে এক বার সংস্কার হওয়ায় তুলনায় কম খারাপ পূর্ত দফতরের অংশটুকু। এলাকাবাসীর ক্ষোভ, রাস্তা সংস্কার ও উন্নয়নের অজুহাতে জেলা পরিষদ ওই পথে টৌল বসিয়ে টাকা আদায় করলেও তারা ওই রাস্তা ঠিক করার ব্যাপারে কোনও উপযুক্ত পদক্ষেপ করে না। তাঁদের অভিযোগ, একই অবস্থা ঢোলকাটা থেকে (ভায়া হরিণসিঙা) রাইপুর পর্যন্ত রাস্তাটিরও। সমস্যায় পড়েছেন রাইপুর, মুর্গাবনি, নিশ্চিন্তপুর, হরিণসিঙা প্রভৃতি গ্রামের হাজার হাজার মানুষও। ফলে দুর্ভোগের শেষ নেই পাঁচামির রাস্তা ব্যবহারকারী থেকে এলাকাবাসীর। এই অবস্থায় পরিস্থিতি না বদলালে বৃহত্তর আন্দোলনে নামার হুমকি দিচ্ছেন এলাকার মানুষ। |
এমনিতে আদিবাসী সম্প্রাদায় অধ্যুষিত পাঁচামি এলাকা নিয়ে জেলা প্রশাসনের অতীত অভিজ্ঞতা অবশ্য খুব একটা ভাল নয়। আদিবাসীদের সংগঠন বীরভূম আদিবাসী গাঁওতা সেখানে নানা বিষয়ে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিশ্রুত পানীয় জলের দাবি যেমন উঠেছে, তেমনই নানা নিয়ম ফাঁকি দিয়ে চলা এলাকার একটা বড় অংশের পাথর খাদান ও ক্রাশারগুলি বন্ধের দাবিতে বহু দিন ধরেই এলাকার আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সরব ছিলেন। সেই আন্দোলনের জেরে এক সময়ে দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ ছিল পাথর শিল্পাঞ্চলের কাজকর্ম। হাজার হাজার শ্রমজীবি মানুষ নিজের কাজ হারিয়ে ছিলেন। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির জেরে রাজ্য সরকারকেও এক সময় হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। বহু আলোচনা ও বৈঠক এবং প্রতিশ্রুতির পরে এলাকার পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। কিন্তু রাস্তাঘাটের সঠিক সংস্কার এবং সার্বিক উন্নয়ন না হওয়া নিয়ে এলাকাবাসীর ক্ষোভ যে রয়েছে তা রাজনৈতিক নেতারাও স্বীকার করছেন।
এলাকাবাসীর দাবি, জেলা পরিষদ ওই রাস্তায় টোল বসিয়ে পাথর বোঝায় প্রতি ছ’ চাকা ও দশ চাকা গাড়ি পিছু ১৫০-২০০ টাকা করে কর আদায় করে। সেই হিসেবে প্রতি দিন গড়ে ১৫০০-২০০০ হাজার গাড়ি ওই রাস্তা ব্যবহার করলে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা জমা হয় জেলা পরিষদের কোষাগারে। কিন্তু রাস্তার চেহারা বদলায় না। তাঁদের আরও অভিযোগ, আগের জেলা পরিষদের বাম বোর্ডের মতোই বর্তমান ক্ষমতাশীন তৃণমূল বোর্ডও রাস্তা সংস্কার-সহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য কিছুই করছে না। দুই গাঁওতা নেতা রবিন সোরেন ও সুনীল সোরেনরা জানান, ঢোলকাটা হয়ে গাড়িগুলি ঝাড়খণ্ডের কলকলি যায়। সেখান থেকেই পাথর বোঝায় হয়ে গাড়িগুলি তালডাঙা, পাথরচাল, তালবাঁধ, সাগর বাথান, সাগর বাঁধি, কাপাসডাঙা, ভাঁড়কাঁটা হয়ে সোঁতশাল মোড়ে জাতীয় সড়কে ওঠে। তাঁদের অভিযোগ, “ঢোলকাটা থেকে পাঁচামি পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা এতটাই ভয়ঙ্কর, তা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না। ওই রাস্তা দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাই দায়। অথচ পেটের দায়ে পাথর নিয়ে চালক ও খালাসিদের দিনের পর দিন ওই রাস্তা দিয়েই চলাচল করতে হচ্ছে।”
প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও। কলেজ ছাত্র শিবলাল হাঁসদা, পূর্ণিমা টুডু থেকে সাগরবাঁধির খোকন মাড্ডি, সাগর বাথানের হপন টুডুরা স্পষ্টই বলছেন, “এখানকার পাথর দিয়েই অন্যত্র রাস্তা তৈরি হচ্ছে। বড় বড় কলকারখানা গড়ে উঠছে। বিশাল বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িও উঠছে। অথচ আমাদেরই রাস্তা নিয়ে প্রশাসনের কোনও হেলদোল নেই।” এলাকার প্রতিটি আদিবাসী ধরে উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়াকে হাতিয়ার করে এ বারই প্রথম এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গায় গাঁওতা ত্রিস্তর পঞ্চায়েতেই তাদের নির্দল প্রার্থী দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে জয়ী হয়েছেন ভাঁড়কাটা পঞ্চায়েতের সাগরবাঁধি সংসদের সদস্যা তথা বারোমেসিয়া গ্রামের আশাকর্মী মানি হাঁসদা। তিনি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সীমিত ক্ষমতাতেও রাস্তা সংস্কার-সহ এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য যা যা করার করবেন।
রাস্তার এই অবস্থার জন্য চিন্তিত পাঁচামি এলাকার ‘মাইনস ও ক্রাশার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনে’র সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিকও। বছর দেড়েক আগে পাঁচামি পর্যন্ত রাস্তাটি পূর্ত দফতর সারাই করলেও সংগঠনকেই তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয় বলে তাঁর দাবি। তিনি বলেন, “ওই রাস্তা দিয়েই এলাকার কচিকাঁচা থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষকে প্রতি দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। আর রাস্তা দিয়ে চলা ট্রাক চালক ও খালাসিদেরও সমান ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হয়।” পাঁচামি এলাকার রাস্তাটি নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে বলে দাবি করছেন জেলা পরিষদের নতুন সভাধিপতি তৃণমূলের বিকাশ রায়চৌধুরী। তাঁর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতো জেলার সমস্ত রাস্তাঘাট সংস্কার ও অন্য উন্নয়নের বিষয়গুলি খতিয়ে দেখা শুরু করেছি। ওই এলাকার রাস্তা নিয়েও ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। দ্রুত সমস্যার সমাধান করা হবে।” পূর্ত দফতরের (সড়ক) ভারপ্রাপ্ত এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র সুরেশচন্দ্র প্রামাণিক জানিয়েছেন, ওই রাস্তার টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। |