শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, ১৪ বছর আগে বিতর্কিত জমিটি ‘হার্টলাইন এস্টেট’ নামে একটি সংস্থার নামে রেজিস্ট্রি করাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন রতনলাল নাহাটা। সে জন্য তিনি মুম্বই গিয়ে একটি পাঁচতারা হোটেলে কয়েক দিন ছিলেন। পুলিশ এ-ও জানতে পেরেছে, সম্পত্তির কারবারি পরাগ মজমুদারকে সঙ্গে নিয়ে নাহাটা নিজেই তৈরি করেছিলেন ওই ভুয়ো সংস্থাটি। সংস্থার ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল মুম্বই। নাহাটা ও পরাগ নিজেরা আড়ালে থেকে কখনও দিলীপ দাস, কখনও আবার রাজেশ দামানিকে এর ডিরেক্টর হিসেবে সামনে রাখতেন। শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডে ধৃত সম্পত্তির কারবারি রাজেশ দামানিকে জেরা করে ভুয়ো সংস্থাটির পিছনে নাহাটার ভূমিকা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, হার্টলাইন এস্টেট নামে সংস্থাটি যখন তৈরি হয়, সে সময়ে রতনলাল ও পরাগ বন্ধু ছিলেন। দু’জনের মধ্যে বিরোধ শুরু হওয়ার পর থেকেই ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমি নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধে। সেটাই চরম আকার নেয় গত ১১ নভেম্বর।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ১৯৯৯ সালে মাত্র সাড়ে ন’লক্ষ টাকায় হার্টলাইন এস্টেটের নামে ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমির রেজিস্ট্রেশন করাতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন রতনলাল। কিন্তু এর পরের বছরই হার্টলাইন এস্টেট যখন ব্যবসায়ী সঞ্জয় সুরেখাকে জমিটি বিক্রি করে, তখন রতনলালকে অন্ধকারে রেখে পরাগ মজুমদারই সে ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, সঞ্জয় সুরেখাকে জমি বিক্রির নথিতে শুধু পরাগ মজুমদারেরই স্বাক্ষর ছিল।
রাজেশকে জেরা করে তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, ৯এ শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে বসেই রতনলাল নাহাটা এবং পরাগ হার্টলাইন এস্টেট সংস্থাটি তৈরি করেন। এর পর শর্ট স্ট্রিটের ওই জমির দলিলও তৈরি করা হয়। যা পরে ব্যবসায়ী সঞ্জয় সুরেখার কাছে বিক্রি করা হয়।
নিজের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্নের মুখে রাজেশ গোয়েন্দাদের জানিয়েছেন, ২০১০ সালে পরাগ মজমুদার তাঁর সঙ্গে রতনলালের পরিচয় করিয়ে দেন। রতনলাল তাঁকে ওই সংস্থার ডিরেক্টর হওয়ার প্রস্তাব দেন এবং তিনি তা মেনে নেন। সে জন্য তাঁকে পৌনে দু’কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল।
পুলিশ সূত্রের দাবি, জেরার মুখে রাজেশ জানিয়েছেন, ওই সংস্থার ডিরেক্টর হওয়ার পর তাঁকে দিয়ে ওই সংস্থার বিভিন্ন কাগজে দশ বছর আগের তারিখ দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়। ভুয়ো সংস্থাটি তৈরির পিছনে পরাগ ও রতনলাল ছাড়া আরও কয়েক জন সম্পত্তির কারবারি ছিলেন বলে পুলিশ জানতে পারেছে। তাঁদের খোঁজ করা হচ্ছে।
তদন্তে এখনও পর্যন্ত যেটুকু জানা গিয়েছে, তা হল, ১৪ বছর আগে হার্টলাইন এস্টেট-এর নামে শর্ট স্ট্রিটের ওই জমির রেজিস্ট্রেশন করানোর সময়ে রতনলাল নাহাটার উদ্যোগে জমির আদি মালকিন শৈলবালা সেনের ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ করা হয়েছিল শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যবসায়ীকে। তাঁকে নিয়েই রতনলাল বিমানে মুম্বই গিয়েছিলেন। রতনলাল তাঁর পরিচিত ওই ব্যক্তিকে মুম্বইয়ের একটি পাঁচতারা হোটেলে কয়েক দিন রেখেছিলেন। পুলিশ জানতে পেরেছে, ২০১০ সালে সঞ্জয় সুরেখার কাছে শর্ট স্ট্রিটের ওই জমি পরাগ মজমুদারের উদ্যোগে হার্টলাইন থেকে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর শিবাজীবাবুকে রতনলাল আগের সেই ঘটনা বেমালুম চেপে যেতে বলেন। কিন্তু শিবাজীবাবু তাতে রাজি হননি।
শনিবার দুপুরে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে তাঁকে লালবাজারে ডাকেন গোয়েন্দারা। পুলিশ সূত্রের খবর, শিবাজীবাবুর কাছে ১৪ বছর আগের কিছু ঘটনা জানতে চাওয়া হয়। মিনিট কুড়ি তাঁর সঙ্গে কথা বলেন গোয়েন্দারা। এ দিন শিবাজীবাবুর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাঁর সামনে শৈলবালা নিজে স্বাক্ষর করে তাঁকে ‘পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ দিয়েছিলেন কি না। শিবাজীবাবু জানান, তাঁর সামনেই শৈলবালা সেন স্বাক্ষর করেছিলেন।
লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “তদন্তের প্রয়োজনে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। আমরা যে তথ্য হাতে পেয়েছি, তার সঙ্গে শিবাজীবাবুর দেওয়া তথ্য মিলে গিয়েছে।”
হার্টলাইন এস্টেটের নামে জমির রেজিস্ট্রেশন হওয়া এবং পরবর্তী কালে ২০১০ সালে ওই জমি শৈলবালা সেনের একটি উইলের ভিত্তিতে রতনলালের কিনে নেওয়া দু’টি ক্ষেত্রেই শৈলবালা সেনের ভাসুরপো দ্বারকানাথ সেনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছিল। এত কিছু সত্ত্বেও জালিয়াতির ব্যাপারটা দ্বারকানাথ কেন বুঝতে পারেননি, সেটা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি, সঞ্জয় সুরেখার কাছ থেকে জমির যে দলিল বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে, সেটি আসল না নকল, গোয়েন্দারা তা-ও খতিয়ে নিচ্ছেন। |