ভোর ৫টার মধ্যে স্নান সেরে বাড়ি থেকে বের হন। তার পর সোজা ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে। সেই থেকে বিকেল পর্যন্ত চা খেয়ে রয়েছেন। তবু বুথের কাছ থেকে সরেননি। গত পুর নির্বাচনে ১ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেও এ বার তাঁর কপালে ভাঁজ পড়েছে। তিনি নান্টু পাল। শিলিগুড়ি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান।
গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। কংগ্রেসের কাউন্সিলররা দলত্যাগ বিরোধী আইনে মামলা করায় পরে তিনি পদ থেকে ইস্তফা দেন। শুক্রবার শিলিগুড়ি পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী তিনি-ই। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস, সিপিএ এবং বিজেপি প্রার্থী দিয়েছেন। পুরসভার অপর ওয়ার্ড ৩১ নম্বরে উপনির্বাচন হলেও এ দিন ১১ নম্বর ওয়ার্ডই ছিল আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র। পুলিশ অবশ্য তৎপর ছিল সকাল থেকেই। বুথে এসে দুই বার ঘুরে যান রিটার্নিং অফিসার তথা মহকুমাশাসক দীপাপ প্রিয়া। মহকুমাশাসক জানান, “নির্বিঘ্নেই ভোট হয়েছে। অপ্রীতিকর কোনও ঘটনা ঘটেনি।”
বৃহস্পতিবার দিনভর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হল জলপাইগুড়ি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডে। কংগ্রেস কাউন্সিলরের মৃত্যুতে ওই ওয়ার্ডে উপনির্বাচন হচ্ছে। ভোটের সপ্তাহখানেক আগেই জেলা কংগ্রেসের অন্যতম যুব নেতা সৈকত চট্টোপাধ্যায় এবং সন্দীপ মাহাতো সহ কর্মী-সমর্থকরা তৃণমূলে যোগ দেন। তার পর থেকেই তাঁদের ওপরেই ওয়ার্ডের ভোট সামলানোর দায়িত্ব ছেড়ে দেয় তৃণমূল। |
শিলিগুড়ি পুরসভার ১১ নম্বর ওর্য়াডে মহিলা
ভোটারদের লাইন। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক। |
যদিও বাসিন্দারা জানিয়েছেন, উত্তেজনার আবহ ছিল যথেষ্টই। সকাল দশটা। লাইনে দাঁড়ানো ভোটারদের মধ্যে দলীয় প্রার্থীর হয়ে প্রচার করাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস এবং তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে হঠাৎই বচসার সূত্রপাত। তবে বচসা তুঙ্গে ওঠার আগেই, খবর পেয়ে রেসকোর্স পাড়া মোড়ে দু’দলের অস্থায়ী বুথ থেকে জেলা নেতাদের ফোন গেল কর্মীদের কাছে। নেতাদের নির্দেশে সরে গেল কর্মী-সমর্থকরাও। সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া সৈকতবাবুদের নেতৃত্বে কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে প্রচার পর্বেই একাধিকবার বচসার ঘটনা ঘটে। ভোটের ২৪ ঘণ্টা আগে থেকেই দু’দলের নেতা কর্মীরাই ওয়ার্ডে জমা হতে থাকেন। তার পর থেকেই চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। সে কারণেই বাসিন্দাদের একাংশ ভোটের দিন অশান্তির আশঙ্কা করেছিলেন। যদিও কংগ্রেস-তৃণমূল দু’দলের শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে শান্তিতেই ভোট চলেছে। ভোটের সময় শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানান সিপিএম নেতারাও।
শিলিগুড়ির ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব থেকে শুরু করে দলের একাধিক কাউন্সিলর কৃষ্ণ পাল, নিখিল সহানিকে এ দিন দেখা গিয়েছে। কংগ্রেসের ডেপুটি মেয়র সবিতা অগ্রবাল, মেয়র পারিষদ রুমা নাথকেও দেখা গিয়েছে সেখানে। পরিস্থিতির উপর প্রতি মূহূর্তে কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের কাছে খবর নিয়েছেন মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত থেকে দলের জেলা সভাপতি শঙ্কর মালাকার। শঙ্করবাবু ১১ নম্বর ওয়ার্ডে মিত্র সম্মিলনী এবং ৩১ নম্বরে শক্তিগড় বালিকা বিদ্যালয়ের এলাকায় যান।
প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য এ দিন হিলকার্ট রোডের পার্টি অফিসেই ছিলেন। বেলা পৌনে ১১টা নাগাদ মিত্র সম্মিলনীর কাছে হিলকার্ট রোডে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গৌতমবাবু চায়ের দোকানে গেলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে কংগ্রেস, বামেদের শিবিরের লোকজন। খোদ মেয়র গঙ্গোত্রী দত্ত অভিযোগ করেন পুলিশ কমিশনারের কাছে। ফোন করে জানান, মন্ত্রী লালবাতির গাড়ি নিয়ে বুথের কাছে গিয়েছেন। প্রশ্ন তোলেন তা হলে তিনি কেন গাড়ি নিয়ে বুথের কাছে যাবেন না? অভিযোগ পেয়ে তৎপর হয় পুলিশ। তবে মন্ত্রী হিলকার্ট রোডের ধারে একটি দোকানে চা খেয়ে ৫ মিনিটের মধ্যেই এলাকা ছাড়লে হাফ ছাড়ে কংগ্রেস। গৌতমবাবু বলেন, “এ সব অযৌক্তিক প্রশ্নের জবাব দিতে চাই না। কলকাতায় যেতে বিমান বন্দরে যাওয়ার সময় হিলকার্ট রোডে দাঁড়িয়েছিলাম। যেখানে চা খেয়েছি সেটা বুথের থেকে অন্তত ৩০০ মিটার দূরে।”
নান্টুবাবুর সঙ্গে এ দিন বুথের কাছে দেখা গিয়েছে তাঁর স্ত্রী মঞ্জুশ্রী দেবীকেও। বুথের সামনে লোকজন নিয়ে জড়ো হয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগ ওঠে নান্টুবাবুর বিরুদ্ধে। পুলিশ তাঁকে একাধিক বার তা থেকে বিরত করেছে। নান্টুবাবুর যুক্তি, “এক ব্যক্তি ভোট দিতে গিয়েছিলেন। বুথ কোথায় জানতে চাইছিলেন। বুথের কর্মীরা তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে বললে বুথের সামনে গিয়ে তাঁকে সে কথাই বলছিলাম। অথচ পুলিশ আমাকে সরিয়ে দেয়। মানুষ সঙ্গে রয়েছে বলেই আমি মনে করি। ভোটের ফলেই তা স্পষ্ট হবে।” জয়ের ব্যাপারে নান্টুবাবু যেমন আশাবাদী, তেমনই আশাবাদী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের প্রার্থী সৌরভ ভট্টাচার্যও। গত নির্বাচনে তিনি-ই ছিলেন নান্টুবাবুর ‘অন্যতম সঙ্গী’। এলাকার বাসিন্দাদেরও তিনি ভাল চেনেন। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে অবশ্য অন্য চিত্র দেখা গিয়েছে। সেখানে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএমের মহিলা প্রার্থীদের এক সঙ্গে বসে গল্প করতেও দেখা গিয়েছে। |
জলপাইগুড়িতে একটি বুথে ভোট। ছবি: সন্দীপ পাল। |
ভোট শেষে অশোকবাবু এবং সিপিএমের দার্জিলিং জেলার কার্যনির্বাহী সম্পাদক জীবেশ সরকার ভোট প্রক্রিয়া নির্বিঘ্নে করার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রী বলেন, “মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার দিতে পেরেছেন। ভয়ভীতি দেখানোর মতো ছোটখাট কিছু ঘটনা ঘটলেও বড় কোনও গোলমাল হয়নি। আমরা দু’টি আসনেই জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।” জীবেশবাবু জানান, মন্ত্রী সরকারি গাড়ি নিয়ে বুথের কাছাকাছি এলাকায় এ দিন গিয়েছিলেন। প্রশাসনকে তাঁরা সেভাবে অভিযোগ না জানালেও বিষয়টি শোভন নয়। তবে তৃণমূলের নেতা, কাউন্সিলররা স্কোয়াড করে বুথের কাছে ঘুরছেন বলে পর্যবেক্ষককে তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন। প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ায় তাঁরা খুশি।
অন্য দিকে, জলপাইগুড়ির ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কোন সমর্থকরা কোন বুথের দায়িত্বে থাকবেন, সাধারণ বাসিন্দাদের ভোট গ্রহণ কেন্দ্র দেখিয়ে দেওয়া, কত ভোট পড়েছে তার হিসেব করার মত সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন তৃণমূলে যোগ দেওয়া সৈকতবাবু। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি মোহন বসু, শহর ব্লক কংগ্রেস সভাপতি পিনাকী সেনগুপ্ত, জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি চন্দন ভৌমিক, সিপিএমের জেলা সম্পাদক কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সদর জোনাল কমিটির সম্পাদক জিতেন দাস দিনভর ওয়ার্ডে উপস্থিত ছিলেন।
ভোটের শেষে কংগ্রেস প্রার্থী সুশীল সিংহ বলেন, “ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের রায়ের উপর ভরসা রেখেছি। পুলিশ দিয়ে তৃণমূল ভোট করানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাসিন্দারাই শেষ কথা বলেছেন।” যদিও তৃণমূল প্রার্থী জয়দেব দেব শর্মা বলেন, “বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই ভোট হয়েছে।” সিপিএম প্রার্থী দীপক মিশির বলেন, “গণতান্ত্রিক পরিবেশেই ভোট হয়েছে।” |