দেবাশিস দাশ ও শান্তনু ঘোষ • কলকাতা |
নির্বাচন কমিশন থেকে রাজ্য প্রশাসন, সকলেরই বিশেষ নজর ছিল হাওড়ার ১ থেকে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের দিকে। শুক্রবার সকালে ভোট শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কার্যত সব থেকে বেশি গণ্ডগোল হল উত্তর হাওড়ার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। নির্বাচনের দিনের প্রথম বোমাটি ফাটল সেখানেই।
বেলা সাড়ে ১১টা। উত্তর হাওড়ার কিংস রোডের সেন্ট অ্যাগনেস স্কুলের বুথের উল্টো দিকে নিজের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাওড়ার মেয়র তথা ওই ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী মমতা জায়সবাল। অভিযোগ, সেই সময়েই পিছনে রেলের একটি গুদামের পাঁচিলের উপর থেকে মমতাদেবীকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। বোমাটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মেয়রের গাড়ির পাশে পড়ে ফেটে যায়। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মমতাদেবী বলেন, “পিছন থেকে আমার মাথায় বোমা মেরে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল তৃণমূল।”
এর পরে ওই ওয়ার্ডেরই গোলাবাড়ি থানার পাশে শ্রীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুথ দখলের খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান মমতাদেবী। স্কুলের ভিতরে তখন অনেক বহিরাগতের ভিড়। পুলিশ তাঁদের বার করার চেষ্টা করছে। সেই সময়েই মমতাদেবী ভিতরে কী হচ্ছে জানতে স্কুলে ঢুকতে চাইলে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা তাঁকে বারণ করেন। মমতাদেবীও ছাড়ার পাত্রী নন। কেন ভিতরে অত লোক থাকবে জানতে চাওয়া মাত্রই শুরু হল আক্রমণ। স্কুলের বাইরে থাকা মোটরবাইকবাহিনী ঘিরে ধরল হাওড়ার মেয়রকে। চলল চড়, ঘুষি, লাথি। মার খেয়ে তিনি ছিটকে পড়লেন নর্দমার ধারে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন পুলিশের কর্তারা। ততক্ষণে অবশ্য বাইক বাহিনী এক্কেবারে হাওয়া। |
পুলিশ ও স্থানীয়েরা মিলে প্রায় সংজ্ঞাহীন মমতাদেবীকে নর্দমার ধার থেকে তুলে প্রথমে স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যান। কিন্তু সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হওয়া মমতাদেবী অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে হাওড়া জেলা হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনাতেই অবশ্য ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের গোলমাল থেমে থাকেনি। আধ ঘণ্টা পরে ওই ওয়ার্ডেরই শৈলকুমার মুখার্জি রোডে তৃণমূল প্রার্থী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির গেট লক্ষ করে দুটি বোমা ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। এ ক্ষেত্রেও সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। বোমা দু’টি মাধবীদেবীর বাড়ির গেটে না লেগে পাশের বাড়ির গেটে গিয়ে ফাটে। ভোট শেষ হওয়ার পরেও বোমাবাজি থামেনি ওই ওয়ার্ডে। পরপর দু’টি বোমা ফাটে সেবা সঙ্ঘ সমিতির সামনে। এই ঘটনায় পুলিশ স্থানীয় দু’টি আবাসনের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এ দিন ১৩ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়াও আর একটি বোমা ফাটে ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের নর্থ ইনস্টিটিউটের বুথের সামনে। তাতে এক সিপিএম কর্মী আহত হন।
তৃণমূলের জেলা সভাপতি (শহর) তথা মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “বোমা মারল বিজেপি আর মেয়র ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাদের নামে কুৎসা রটাচ্ছেন। অসুস্থতার নাটক করছেন।” আর এক মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “হার নিশ্চিত জেনে কংগ্রেস ও বিজেপিকে সঙ্গে নিয়ে আজকের গোলমালের চিত্রনাট্য তৈরি করেছিল সিপিএম। মেয়র মমতাদেবী অভিনেত্রী হিসেবে খুব দুর্বল। তাই মানুষের কাছে সমস্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন বলেই মনে হয়েছে।” তবে বিজেপি-র হাওড়া জেলা সভাপতি শ্যামল হাতির দাবি, “যে সন্ত্রাস তৃণমূল করল, তার কাছে সিপিএমের সন্ত্রাসও লজ্জা পাবে। মেয়রকে বোমা তৃণমূলই মেরেছে।”
এই ঘটনাগুলি ছাড়া হাওড়া শহরের উত্তর থেকে মধ্য হয়ে দক্ষিণ পর্যন্ত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ছোটখাটো গোলমালের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে সপ্তম হাওড়া পুর-নির্বাচন। মোটের উপর নির্বাচন শান্তিপূর্ণ বলেই দাবি প্রশাসনের। হাওড়ার মহকুমা শাসক (সদর) বাণীপ্রসাদ দাস বলেন, “হাওড়ায় দু’একটি ছোট গোলমাল ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবেই শেষ হয়েছে।” হাওড়া সিটি পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (সদর) নিশাত পারভেজের দাবি, “যেখানেই গোলমালের খবর এসেছে, সেখানেই আমাদের পদস্থ কর্তারা নিজেরা গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। তাই কোনও বড় ধরনের কোনও ঘটনা ঘটেনি।” এ দিন পুর নির্বাচনে ভোট পড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। যা ২০০৮-এর নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ কম।
এ দিন সকালে নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকেই শহরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে বোমাবাজি ও বুথ জ্যামের অভিযোগ আসতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ঘুসুড়ি থেকে বটানিক্যাল গার্ডেন পর্যন্ত ৩০-৪০টি বাইকে চেপে বহিরাগত যুবকেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠে। কিন্তু তার দায় কোনও রাজনৈতিক দলই নিতে চায়নি। তবে মাঝেমধ্যে কয়েকটি জায়গায় বুথের সামনে থেকে বহিরাগতদের জটলা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশকে লাঠি ও বন্দুক উঁচিয়ে তাড়া করতেও দেখা যায়।
বেলা ১২টা নাগাদ ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের গরফা মসজিদতলায় একটি বস্তা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছিলন তিন যুবক। সন্দেহ হওয়ায় তাদের পাকড়াও করে স্থানীয় লোকেরাই পুলিশের হাতে তুলে দেন। বস্তা খুলে ১৮টি তাজা বোমা উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতার করে তিন জনকে। ভাঙচুর হয় কোনা হাইস্কুলের কাছে সিপিএমের ক্যাম্প অফিস। গুলমোহর রেল আবাসনের একটি বুথে পুলিশকে ধাক্কা মেরে ৫০-৬০ জন যুবক ভিতরে ঢুকতে চায় বলে অভিযোগ।
বামফ্রন্টের হাওড়া জেলা আহ্বায়ক বিপ্লব মজুমদারের অভিযোগ, “রাজ্য প্রশাসনের সহযোগিতায় হাওড়া পুর-নির্বাচনকে এক প্রহসনে পরিণত করেছে তৃণমূল। উত্তর হাওড়ার ১ থেকে ৭ নম্বর এবং ১০ থেকে ১৫ নম্বর মিলিয়ে মোট ১৩টি ওয়ার্ডে ব্যাপক ছাপ্পা ভোট হয়েছে। সেখানে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। ৬ জন প্রার্থীকে তৃণমূল দুষ্কৃতীরা মারধর করেছে।” কংগ্রেসের হাওড়া জেলা সভাপতি আব্দুল রেজ্জাক বলেন, “উত্তর ও দক্ষিণ হাওড়ায় ব্যাপক রিগিং ও ছাপ্পা ভোট হলেও মধ্য হাওড়ায় ভোট শান্তিতে, নির্বিঘ্নে হয়েছে। পঞ্চায়েতের থেকে তুলনামূলক ভাবে পুর-নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ভাল ছিল।” যদিও তৃণমূল নেতৃত্ব এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
|