এক ঝলক দেখলে কে বলবে এলাকায় উপ-নির্বাচন হচ্ছে?
অলিতে-গলিতে শোভা পাচ্ছে নেতা-নেত্রীর ছবি লাগানো ব্যানার ও কাট-আউট। সকালে পদযাত্রা তো বিকেলে পাড়ায় মিছিল। প্রার্থীদের হাতজোড় করে ভোট নিবেদন। রাজনৈতিক দলগুলির পরস্পরের বিরুদ্ধে তোপ দাগা। সব মিলিয়ে পুরুলিয়া পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচন এখন শহরবাসীর বড় অংশেরই আলোচনার কেন্দ্রে।
২০১০ সালের পুরভোটে ৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জেতা গীতা মণ্ডল পরবর্তী কালে তৃণমূলে যোগ দেন। তিনি পদত্যাগ করায় এই ওয়ার্ডে উপ-নিবার্চন হচ্ছে। মোট ২২ আসনের পুরসভায় ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে এই একটি ওয়ার্ডের ফল যে আলাদা মাত্রা যোগ করবে, তা কিন্তু নয়। কেন না এখানে তৃণমূলেরই ১১টি আসন। কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের ঝুলিতে যথাক্রমে ৭ ও ৩টি আসন। তা হলে কেন এই অকাল-ভোট ঘিরে এত উত্তেজনা? উত্তরটা লুকিয়ে রয়েছে রাজনৈতিক জমি দখলের মধ্যে। এই ওয়ার্ডের দখল পেলে পুরসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে তৃণমূল। অন্য দিকে, বিরোধীদের যেই জিতুক, তারা দাবি করবে, খাস সদরেই শাসকদলকে ধাক্কা দেওয়া গেল। |
এই ওয়ার্ডে প্রচার করেছেন সব দলেরই হেভিওয়েটরা। শাসকদল মাঠে নামিয়েছে তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো, জেলা পরিষদের সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো, পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায়কে। কংগ্রেসের হয়ে প্রচারে নেমেছেন দলের জেলা সভাপতি নেপাল মাহাতো, বিধায়ক উমাপদ বাউরি, প্রাক্তন পুরপ্রধান সৈয়দ সাকিল আহমেদ, জেলা কমিটির সহ-সভাপতি রথীন্দ্রনাথ মাহাতো প্রমুখ। অন্য দিকে, সিপিএম প্রার্থীর হয়ে প্রচার সেরেছেন জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক মণীন্দ্র গোপ, সাংসদ নরহরি মাহাতো, আরএসপি নেতা অত্রি চৌধুরী, ফরওয়ার্ড ব্লকের নিশিকান্ত মেহেতা, সিপিএমের পুরুলিয়া জোনাল কমিটির সম্পাদক কৌশিক মজুমদার প্রমুখ।
শহরের এই ওয়ার্ডে এযাবত্ বেশির ভাগ সময় ডানপন্থীরাই জিতেছেন। গত নিবার্চনেও তৃণমূলের কবিতা দাসকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের গীতা মণ্ডল। চলতি মে মাসে তিনি পদত্যাগ করেন। তার জেরেই উপ-নির্বাচন। ভোটের লড়াই এখানে ত্রিমুখী। তৃণমূলের প্রার্থী এ বারও কবিতা দাস। কংগ্রেসের হয়ে লড়ছেন জয়া ভুঁইয়া। আর সিপিএম প্রার্থী করেছে প্রমীলা দাসকে। কবিতাদেবীকে জেতাতে আদা-জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন এলাকার পরিচিত তৃণমূল নেতা, একাধিক বারের কাউন্সিলরের গোবিন্দ মুখোপাধ্যায়। অতীতে তাঁর স্ত্রী মৃদুলাদেবীও তৃণমূলের টিকিটে কাউন্সিলর হয়েছেন। তবে, দল টিকিট না-দেওয়ায় গত পুরভোটে গোবিন্দবাবু ছিলেন কংগ্রেস শিবিরে। আনকোরা প্রার্থী গীতা মণ্ডলের হয়ে কাজ করে ঘরের সিট থেকে তাঁকে জিতিয়ে এনেছিলেন। নিজে অবশ্য পাশের ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে লড়ে হেরে যান। এ বার পুরনো দলের সঙ্গে মান-অভিমানের পালা কেটেছে। গোবিন্দবাবু ফের তৃণমূল শিবিরে। এলাকায় নিবার্চনী কাযার্লয় খুলে বসেছেন। বললেন, “লড়াই হবে তৃণমূল আর কংগ্রেসের মধ্যে।” |
এই ওয়ার্ডের ভোটারদের একটা বড় অংশই বস্তিবাসী। চিড়াবাড়ি, রামবাঁধপাড়া, ভুঁইয়াপাড়া, দুলমি-সহ লাগোয়া বস্তি এলাকায় এই ওয়ার্ডের ৪,৮৮৪ ভোটারের একটা বড় অংশের বাস। বিরোধীরা পুর-পরিষেবার বঞ্চনার পাশাপাশি বর্তমান পুরবোর্ড অযোগ্য দাবি করে প্রচারে নেমেছেন। সিপিএম নেতা কৌশিকবাবু বলেন, “এই ওয়ার্ড থেকে বেশির ভাগ সময় বাম-বিরোধীদেরই জয়ী করেছেন ভোটারেরা। কিন্তু, তাঁরা নিজেদের প্রশ্ন করুন, ভোটের সময় যা যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় আদতে তার কতটা এলাকায় প্রতিফলিত হয়েছে।” কংগ্রেস প্রার্থী জয়াদেবীর স্বামী রিকশাচালক। ভুঁইয়াপাড়ার বাসিন্দা জয়াদেবী বলছেন, “এলাকার মানুষ পুর-পরিষেবা পাননি বললেই চলে। সেটাই প্রচারে বেরিয়ে বলছি।” যদিও ঘটনা হল, গত পুরবোর্ড ছিল কংগ্রেস-তৃণমূলের জোটেরই দখলে।
বস্তুত, পুর-পরিষেবা নিয়ে এলাকায় যথেষ্টই ক্ষোভ আছে। শঙ্কর ভুঁইয়া, শান্তি ভুঁইয়া, রাজু ভুঁইয়াদের কথায়, “পানীয় জলের সমস্যা খুবই বেশি। আমাদের এলাকায় রাস্তাঘাটও অন্ধকার। নিকাশির হাল শোচনীয়। বৃষ্টি হলে রাস্তায় হাঁটা যায় না।” ভোটের দু’দিন আগেও চিড়াবাড়ি বস্তি এলাকায় দেখা গিয়েছে, রাস্তার পাশে জঞ্জালের স্তূপ। নর্দমার জল বইছে রাস্তার উপরে। ওই নোংরা জল ডিঙিয়েই যাতায়াত করছেন পড়ুয়া থেকে এলাকার লোকজন। ফলে, এই ভোট নিয়ে তাঁদের খুব একটা হেলদোল নেই। তাঁদের ক্ষোভ, “প্রতিবার ভোটেই নেতারা এসে গালভরা প্রতিশ্রুতি দেন। তার পরে আর এলাকার হাল বদলায় না।” পুর-পরিষেবা সংক্রান্ত বিরোধী প্রচারকে নস্যাত্ করে তৃণমূল নেতা গোবিন্দবাবু ও দলীয় প্রার্থী কবিতাদেবীর দাবি, “এ সবের প্রভাব পড়বে না। আমরাই জিতব।” পুরপ্রধান তারকেশ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, “ওই ওয়ার্ডে সমস্যা যে নেই, তা বলব না। ওখানে অনেক দিন হল কাউন্সিলর নেই। তাই একটা ফাঁক তো থেকেই যাচ্ছে। মানুষ পরিষেবা না পেলে বলবেনই। তবু জেতার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।” |