সময়ে কাজ শেষ করার জন্য কড়া বার্তা দিচ্ছিলেনই। এ বার সে ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ নজরদারিরও ব্যবস্থা করে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রথমে রুদ্ধদ্বার প্রশাসনিক বৈঠকে, তার পরে সোমবারে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানেই কাজ ফেলে রাখা নিয়ে নিজের প্রশাসনকে বিঁধেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই তালিকায় যেমন আছেন শীর্ষস্তরের কর্তাব্যক্তিরা, তেমনই রয়েছেন তৃণমূল স্তরের কর্মীরাও। বাদ যাননি মন্ত্রীরাও। এর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই নির্দেশ দিলেন প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরির।
কী এই প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার? সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, দফতরগুলি প্রথমে ঠিক করুক, কোন কাজ কত দিনে শেষ করা হবে। তার পরে সময়ে সময়ে সেই কাজ কতটা এগোলো এবং বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তা শেষ হল কি না, তা-ও জানাতে হবে। প্রকল্প ধরে ধরে সেগুলি শেষ করার সময়সীমা তৈরি করে নেওয়ার বিষয়টিকেই মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার বলে উল্লেখ করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সূত্রে সব দফতরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০১৪ সালের প্রথম দিন সাবেকি ক্যালেন্ডার টাঙানোর পাশাপাশি প্রতিটি দফতরকে তৈরি করতে হবে কাজের ক্যালেন্ডারও। নবান্ন সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই ওই ক্যালেন্ডার তৈরির প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন বিভিন্ন দফতরের সচিবরা। এবং তা যাতে নিখুঁত হয়, সেই লক্ষ্যে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রকে সমস্ত দফতরের সচিবদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মমতার নির্দেশ মেনে প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরির রূপরেখা নির্দিষ্ট করতে আগামী শনিবার সব সচিবকে বৈঠকে ডেকেছেন মুখ্যসচিব।
এই প্রশাসনিক ক্যালেন্ডারকেই প্রশাসনের কেউ কেউ বলছেন ‘রোড ম্যাপ’। কর্তাব্যক্তিদের একাংশের বক্তব্য, এত দিন বিভিন্ন প্রশাসনিক বৈঠকে যে কথাগুলো বলে আসছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরি করে দফতরের আধিকারিকদের কাছে এ বার তারই লিখিত প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চাইছেন তিনি। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “স্কুলে পড়ুয়াদের ‘হোম টাস্ক’ দেন শিক্ষকরা। এ বার অফিসারদেরই নিজের ‘হোম টাস্ক’ তৈরির নির্দেশ দিলেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।” ‘হোম টাস্ক’ তৈরিতেই যে কাজ শেষ হচ্ছে না, দিন ক্ষণ ধরে কাজটাও শেষ করতে হবে, দফতরের সচিবদের কাছে সেই বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর।
দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি দফতরে কাজের গতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। মুখ্যমন্ত্রী সেটাই বদলাতে চাইছেন বলে মনে করছে সচিবদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, আর সেটা করতে গিয়ে তিনি রাজ্য প্রশাসনে ‘ম্যানেজমেন্ট ইনপুট’ চালু করার কথা বলছেন। কী এই ‘ম্যানেজমেন্ট ইনপুট’? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “বহু বেসরকারি সংস্থায় বছরের গোড়াতেই কাজের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। কর্মীরাই ওই ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। বছরের শেষে কর্তৃপক্ষ সেই লিখিত লক্ষ্যমাত্রা ধরে কাজের খতিয়ান মিলিয়ে নেন। এবং সেই সাফল্য মেপেই কর্মক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মীর যোগ্যতা বিচার হয়।”
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বছর শেষে কাজের মূল্যায়ন করে বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই, সে কথা মানছেন প্রশাসনিক কর্তাদের একটি অংশ। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শে যে জন পরিষেবা আইন চালু হয়েছে, সেখানে কিন্তু শাস্তি এবং বাহবার ব্যবস্থা আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পরিষেবা দিতে দেরি হলে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মী বা অফিসারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে ওই আইনে। এর পাশাপাশি দফতরে দফতরে ফাইলের অবস্থান জানতে ‘ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম’ চালুরও প্রক্রিয়া চলছে।
মমতার প্রচেষ্টা আজকের নয়। প্রথম থেকেই একাধিক প্রশাসনিক বৈঠকে দফতরের আধিকারিকদের পাখিপড়ার মতো একটা কথা বোঝাতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী কোনও মতেই কাজ ফেলে রাখা চলবে না, ঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ করতে হবে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, কাজ শেষ করার সময়সীমা দিয়েও কথা রাখতে পারেনি একাধিক দফতর।
মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক কর্তা বলছিলেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রকল্প ঘোষণার পাশাপাশি মমতা কাজ শেষের যে সময়সীমা বেঁধে দেন, তা কম্পিউটারে ঢুকিয়ে রাখা হয়। মুখ্যমন্ত্রী মাঝেমধ্যেই সেই তথ্য ধরে দফতরের আধিকারিকদের
কাছে কাজের গতি সম্পর্কে জানতে চান। কিন্তু প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে সরকারি আধিকারিকদের একাংশের কাজকর্মে যে তিনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন, সে কথা প্রশাসনিক বৈঠকে কিংবা প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে রেবারেই বুঝিয়ে দিয়েছেন মমতা। সোমবার সেই কথাই আর এক বার
বলেন। আর তার পরেই এলো মঙ্গলবারের ঘোষণা। |