প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের বিরুদ্ধে ১৭ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনলেন প্রাণিবন্ধুরা। তাঁদের অভিযোগ, প্রশিক্ষণের জন্য প্রাণিবন্ধুদের কেন্দ্রীয় অনুদান তোলা হলেও, তাঁদের তা দেয়নি রাজ্য। দফতরের মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী বলেছেন, “বিষয়টি আমার জানা নেই।” তৃণমূলেরই একটি কর্মচারী সংগঠন অবশ্য দাবি করেছে, তাঁদের সদস্যরা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি আগেই জানিয়েছেন। তদন্ত চেয়ে প্রাণিবন্ধুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হয়েছেন।
দুর্নীতির অভিযোগটি ঠিক কী? রাজ্য প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর সূত্রের খবর, ২০০০ সাল নাগাদ দেশ জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘ন্যাশনাল প্রজেক্ট অন ক্যাটল অ্যান্ড বাফেলো ব্রিডিং’ প্রকল্পে প্রাণিবন্ধুদের নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই রাজ্যেও ২০০২ সালে ওই প্রকল্পের অধীনে প্রায় প্রতিটি পঞ্চায়েতে একজন করে প্রাণিবন্ধু নিয়োগ করা হয়। এই রাজ্যে প্রাণিবন্ধুদের নিয়োগের দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরেরই অধীন পশ্চিমবঙ্গ গো-সম্পদ বিকাশ সংস্থাকে। এই সংস্থা সূত্রের খবর, বর্তমানে রাজ্যে প্রাণিবন্ধুর সংখ্যা ৩১৬৭ জন। নিয়োগের পরে প্রাণিবন্ধুদের সাড়ে চার মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
প্রাণিবন্ধুদের দাবি, রাজ্য সরকারের তরফ থেকে তাঁদের জানানো হয়েছিল, প্রশিক্ষণের জন্য মাথাপিছু ১১ হাজার ৪৯৭ টাকা করে পাবেন। এ ছাড়া প্রজননের কাজে ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখার জন্য একটি ছোট জার, লিকুইড নাইট্রোজেন গ্যাস রাখা-সহ একটি বড় জারের জন্য ৩০ হাজার টাকা এবং যখন তাঁরা কাজ করবেন সেই সময়ে আরও ৬ হাজার টাকা করে তাঁদের দেওয়া হবে। সব মিলিয়ে এক একজন প্রাণিবন্ধুর পাওয়ার কথা ছিল ৫২ হাজার ৪৯৭ টাকা। প্রাণিবন্ধুদের অভিযোগ, যে সব জিনিস তাঁদের দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল তার কোনওটিই তাঁরা পাননি। দেওয়া হয়নি একটি টাকা। উল্টে পরবর্তীকালে বেশ কয়েকজন প্রাণিবন্ধুর কাছ থেকে ছোট জার এবং যন্ত্রপাতির জন্য বিভিন্ন ব্লক প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতর ৫ হাজার টাকা করে নিয়েছে।
প্রাণিবন্ধুদের সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রাণিবন্ধু সমিতির সম্পাদক শেখ সাদিকুল সিরাজ বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ গো-সম্পদ বিকাশ সংস্থার বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পেরেছি, কেন্দ্রীয় সরকার ওই প্রকল্পে আমাদের জন্য যে টাকা বরাদ্দ করেছিল তা ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় তুলে নেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা তা পেলাম না।” প্রাণিবন্ধুদের অভিযোগ, সব মিলিয়ে মোট ১৬ কোটি ৬২ লক্ষ ৫৭ হাজার ৯৯৯ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। তদন্তের দাবিতে তাঁরা আন্দোলন করলেও তা মানা হয়নি।
উল্লেখ্য, নতুন করে কাজের শর্ত বেঁধে দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে চুক্তি সই করাকে কেন্দ্র করেও প্রাণিবন্ধুদের সঙ্গে গো-সম্পদ বিকাশ দফতরের বিবাদ বেধেছে। এই চুক্তিকে তাঁদের স্বার্থবিরোধী বলে মন্তব্য করে প্রাণিবন্ধুরা তাতে সই করতে বেঁকে বসেছেন। প্রাণিবন্ধুদের অভিযোগ, চুক্তিতে সই করলে ভবিষ্যতে কখনও তাঁদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক বা ভাতা চাইতে পারবেন না। নতুন চুক্তি সই না হওয়ায় কাজ বন্ধ রয়েছে গত ২০ দিন, জানিয়েছেন সংগঠনের সহকারী সম্পাদক বিশ্বজিৎ নন্দী।
প্রাণিবন্ধুদের অভিযোগটিকে আমল না-দেওয়ায় প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রীর সমালোচনা করেছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারি কর্মচারি সংগঠন ‘ইউনাইটেড স্টেট গভর্নমেন্ট ফেডারেশন।’ সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমি নিজে মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে প্রাণিবন্ধুদের তোলা দুর্নীতির অভিযোগটির তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। তার পরেও মন্ত্রী কেন বিষয়টি জানেন না বলেছেন তা বুঝতে পারছি না।’’
প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বামফ্রন্ট নেতা নারায়ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিহারে যদি পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির সিবিআই তদন্ত হয় এখানেও তদন্ত হবে না কেন?” দুর্নীতির যখন থেকে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে তখন তো তিনিও দফতরের মন্ত্রী ছিলেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে নারায়ণবাবু বলেন, “দুর্নীতি যে আমলেই হোক না কেন তা বড় কথা নয়। সত্য উদঘাটন হওয়া প্রয়োজন।”
বর্তমান মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরিই শুধু নন, এ ব্যাপারে মুখ খুলতে চাননি রাজ্য প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের কোনও আধিকারিকই। পশ্চিমবঙ্গ গো-সম্পদ বিকাশ সংস্থার মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সুভাষ বসু বলেন, “কোনও দুর্নীতিই হয়নি।” তা হলে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠছে কেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও উত্তর দিতে অস্বীকার করেন। |