কলকাতা-সহ দেশের বড় শহরগুলির দূষণ কমাতে সম্প্রতি একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক। শহরের মধ্যে পেট্রোল-ডিজেল চালিত যানবাহনের ব্যবহার যথাসম্ভব কমানোর মতো প্রস্তাবের কথা সেখানে বলা হয়েছে। জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে এক দিকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও অন্য দিকে খরচ কমানোর ব্যাপারে পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের ওই সব প্রস্তাব যে কতটা প্রাসঙ্গিক, কলকাতাকে পরিবেশবান্ধব করার দিশা দিতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটেনের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করা একটি যৌথ সমীক্ষায় বেরিয়ে এসেছে সেটাই।
পরিবহণের ক্ষেত্রে কলকাতাকে পরিবেশবান্ধব করে তুলতে ওই সমীক্ষা-রিপোর্টে সাইকেলের জন্য আলাদা পথ করে দেওয়া, লজ্ঝড়ে হয়ে যাওয়া ট্রামের বদলে ঝকঝকে ট্রাম এনে সামগ্রিক ভাবে এই পরিবেশবান্ধব যানের ব্যবহার বাড়ানো, ব্যস্ত সময়ে একটি গাড়িতে একসঙ্গে কয়েক জনের চড়া (যাতে গাড়ি ও জ্বালানির ব্যবহার কমে), পেট্রোল-ডিজেলের বদলে এলপিজি-চালিত গাড়ি বেশি করে চালানো, ভারত স্টেজ (বিএস)-ফোরের মতো গাড়ির ইঞ্জিনের পরিবেশবান্ধব মানদণ্ড মেনে চলায় নজরদারির মতো প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
ওই সমীক্ষা-রিপোর্টের নাম ‘দি ইকনমিক্স অব আ লো কার্বন কলকাতা’। সদ্য দায়িত্ব নেওয়া পূর্ব ভারতের নয়া ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার স্কট ফার্সেডন উড বুধবার আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেন। কয়লা এবং পেট্রোল-ডিজেলের মতো চিরাচরিত জ্বালানিতেই কার্বন থাকে। ওই সব জ্বালানি পোড়ালে বাতাসে মেশে কার্বন ডাই-অক্সাইড। যা বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উপাদান। তাই বিশ্ব জুড়ে বাতাসে কার্বন ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং জ্বালানি ও বিদ্যুতের মতো প্রয়োজন মেটাতে বিকল্প শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে কলকাতার বর্তমান অবস্থা এবং কলকাতা কী ভাবে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের পথে হাঁটতে পারে, সে কথা মাথায় রেখেই গত দেড় বছর ধরে ব্রিটিশ সংস্থা ‘সেন্টার ফর লো কার্বন ফিউচার্স’-এর সহায়তায় ওই সমীক্ষা হয়েছে।
কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। নগর এলাকার নিরিখে বিশ্বে ১৯তম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে ওই সমীক্ষার নেতৃত্ব দিয়েছেন অর্থনীতির শিক্ষিকা জয়শ্রী রায়। তাঁর বক্তব্য, “কলকাতা যে ভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী ২০২৫ সালে কলকাতার কার্বন নিষ্ক্রমণ এখনকার তুলনায় ২৫ শতাংশ বাড়বে। ওই সময়ে শক্তি ও জ্বালানির খরচের সম্ভাব্য হিসেব করে এটা বলা হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বর্তমান হারে চললে কলকাতা থেকে বাতাসে কার্বন এখনকার তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি ছড়াবে।”
তার ফল কী হবে?
জয়শ্রীদেবী বলেন, “সে ক্ষেত্রে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ কলকাতার অবদান থাকবে। দূষণ আরও বাড়বে।
ভারত সরকার ২০০৫-এর তুলনায় ২০২৫-এ ২৫ শতাংশ কম কার্বন নিষ্ক্রমণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। কাজেই, ভারতের প্রতিটি বড় শহরকেই চেষ্টা করতে হবে, যাতে বাতাসে কম কার্বন ছড়ায়।”
শুধু তা-ই নয়। সমীক্ষকদের হিসেবে, অতিরিক্ত পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাগুলি না নিলে কলকাতার ‘এনার্জি বিল’ অর্থাৎ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং আনুষঙ্গিকের জন্য খরচ ২০১২-য় যা ছিল, ২০২৫-এ তার দ্বিগুণ হবে। গবেষকেরা দেখেছেন, ২০১২-তে কলকাতার ‘এনার্জি বিল’ ছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। তা ছাড়া, গবেষকদের বক্তব্য, বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি অর্থসাহায্য থেকেও বঞ্চিত হবে কলকাতা।
তা হলে উপায়?
লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে ওই সমীক্ষার নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষক অ্যান্ডি গোউল্ডসন নিদান দিচ্ছেন, “শহরের নির্মীয়মাণ মেট্রো রেল প্রকল্পগুলি চালু হলে কলকাতা আরও বেশি পরিবেশবান্ধব হবে। ১৫ বছরের পুরনো গাড়িগুলির জায়গায় ১০ বছরের পুরনো গাড়ি বাতিল করা হোক। দূষণ সৃষ্টিকারী গাড়ি শহরে ঢুকলে তাদের কাছ থেকে মোটা টাকা কর নেওয়া যেতে পারে। আবার পরিবেশ-বান্ধব গাড়িগুলিকে এ ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হোক।”
বিদ্যুতের ক্ষেত্রে সৌরশক্তির ব্যাপক ব্যবহার, বিদ্যুতের খরচ সাশ্রয়কারী রেফ্রিজারেটর ও এসি ব্যবহার, চার্জার খুলে নেওয়া বা রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সুইচ অফ করার অভ্যাস তৈরির কথা বলে সমাধানসূত্র বাতলানো হয়েছে সমীক্ষায়।
ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার স্কট ফার্সেডন উড বলেন, “কলকাতাকে পরিবেশবান্ধব করে তোলার ক্ষেত্রে দিশা দেখানোর লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সম্প্রতি কলকাতা পুরসভার মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। কলকাতা পুরসভার ‘ভিশন ২০২০’-র অঙ্গই হল, দূষণমুক্ত কলকাতা গড়ে তোলা।” রাজ্য সরকার ও কলকাতা পুরসভার কাছে সমীক্ষা-রিপোর্টটি শীঘ্রই জমা দেওয়া হবে। তবে এই ধরনের সমীক্ষার সুপারিশকে স্বাগত জানালেও বাস্তবে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন রাজ্যের কয়েক জন মন্ত্রী। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলছেন, “কলকাতার ট্রামলাইন শহরের মাঝখানে। এটা বড় সমস্যা। সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানকেও কলকাতা শহরের রাজপথে চালানোর উপায় নেই। এখানে দৈনিক গাড়ির চাপ ১৫ লক্ষ। নাগরিকদের বহু দিনের অভ্যাস আটকে দুম করে কিছু করতে গেলে সমস্যা হবে।” যুবকল্যাণ ও আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য, “ওই সমীক্ষা রিপোর্ট ভাল ভাবে পড়ে দেখতে হবে। সুপারিশগুলির কতটা এখানকার বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই, সেটা দেখা জরুরি।” |