নবান্ন-চালেই কি কিস্তিমাত হবে গঙ্গাপারে |
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
তিনি নিজে প্রচারে আসেননি। কিন্তু রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতরটাই গঙ্গা পেরিয়ে তুলে এনেছেন!
প্রাচীন জনপদের বাসিন্দাদের মনে সুদীর্ঘকালের যে ‘বঞ্চনা’ বোধ, তাতে প্রলেপ দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ‘নবান্ন’-উপহারই এ বার হয়ে উঠেছে তৃণমূলের মোক্ষম হাতিয়ার। শহরের ৫০টি ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী-সহ রাজ্য প্রশাসন উঠে এসেছে হাওড়ায়। এ বার হাওড়া পুরসভায় শাসক দলকে ক্ষমতায় আনলে পরিষেবা নিয়ে দীর্ঘ দিনের অভিযোগেরও সুরাহা হবে।
হাওড়া জেলার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “হাওড়া পুরসভায় কবে থেকেই বামেরা ক্ষমতায়। পানীয় জল, নিকাশির মতো গুরুত্বপূর্ণ কোনও পরিষেবাই তাঁদের বোর্ড দিতে পারেনি। পরিবর্তন আনতে নবান্ন তো কাজে লাগবেই!”
প্রত্যাশিত ভাবেই ঘোর আপত্তি তুলছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের পাল্টা যুক্তি, “এ এক ধরনের দীনতা। রাজনৈতিক বক্তব্য কিছু না-থাকলে লোকে এই সব বলে।” সঙ্গে জুড়ছেন, “কোনও প্রয়োজনে প্রশাসনিক সদর দফতরের স্থানান্তরকে যদি কৃতিত্ব বলে প্রচার করতে হয়, তা হলে তো আমাদেরও বলার আছে। এই নবান্ন বাড়িটা তো বাম প্রশাসনেরই তৈরি।”
মাত্র কয়েক মাস আগে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে সিপিএম প্রার্থী ছিলেন শ্রীদীপবাবুই। সারদা-কাণ্ডের অব্যবহিত পরেই সে নির্বাচনে অবশ্য ২০১১-র বিধানসভা ভোটের চেয়ে ভাল ফল করে বামেরা। বিধানসভা ভোটে হাওড়া জেলায় বিধায়ক-শূন্য হয়েছিল বামেরা, হাওড়া পুরসভায় কোনও ওয়ার্ডেই তারা ‘লিড’ পায়নি। পক্ষান্তরে শ্রীদীপবাবু বামেদের এগিয়ে রাখতে পেরেছিলেন ১৫টি ওয়ার্ডে। বাকি ৩৫টি তৃণমূল। এ বার কী হবে? শ্রীদীপবাবুর মতে, “উপনির্বাচনের সঙ্গে এই পুর নির্বাচনের অনেক ফারাক। উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী দিলে এবং উত্তর হাওড়া, বালি-সহ কিছু জায়গায় সন্ত্রাস না হলে আমরাই জিততাম। এ বার হুমকি, হামলা আছে। কিন্তু সেই উপনির্বাচন, তার পরে পঞ্চায়েত ও ১২টি পুরসভার ভোট দেখে মানুষও বুঝছেন, তৃণমূল কী ভাবে জিততে চাইছে। তাই প্রচারে কিছুটা সাড়া পাচ্ছি।”
সিপিএমের এই দাবি ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না তৃণমূল। তাদের পাল্টা দাবি, কর আদায় করেও জল ও নিকাশি পরিষেবা দিতে ব্যর্থ বাম বোর্ড। সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। রাজ্য জুড়ে তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে যে হাওয়া, তার ঝাপ্টাতেই লোকসভা ভোটের আগে হাওড়ায় হাওয়া হয়ে যাবে বাম-সহ সব বিরোধী। বাকি বিরোধী বলতে কংগ্রেসের অবস্থা অবশ্য শোচনীয়। দলবদল ও সাংগঠনিক বিপন্নতার ধাক্কা সামলে এখন হাতে-থাকা ৪টি ওয়ার্ড ধরে রাখাই তাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। লোকসভার উপনির্বাচনে না থাকলেও পুরভোটের ময়দানে অবশ্য বিজেপি আছে। তাদের প্রার্থীরা ৪২টি ওয়ার্ডে। বিজেপি-র রাজ্য নেতা ঋতেশ তিওয়ারি বলেন, “বামেদের জয়ের আশা নেই, এটা ঠিক। তবে সুষ্ঠু ভোট হলে উত্তর হাওড়ার অন্তত তিনটি-সহ মোট ৫টি ওয়ার্ড জেতা উচিত বলে বিজেপি আশাবাদী।”
সম্ভবত হাওয়া বুঝেই, হাওড়ায় এ বার প্রার্থী তালিকায় ব্যাপক রদবদল করেছে বামফ্রন্ট। বড় সমাবেশের দিকে তারা যায়নি, রাজ্য সিপিএমের পরিচিত মুখেরাও কেউ প্রচারে আসেননি। জয়ের গন্ধ পেয়ে তৃণমূলের হয়ে অবশ্য জেলার দুই মন্ত্রী অরূপ রায়, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি মুকুল রায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, সৌগত রায়েরা প্রচারে নেমেছেন। উল্টো দিকে, বামেরা বাড়ি এবং পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জন-অসন্তোষের ফায়দা নিতে চেয়েছেন। নিশানা করেছেন মন্ত্রী অরূপবাবুকেই। সিপিএমের হাওড়া জেলা সম্পাদক বিপ্লব মজুমদারের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, দফতর তোমার থাকুক। কাজটা আমি দেখব। এতেই তো বোঝা যায়, সব্জির মূল্যবৃদ্ধির সময়ে মন্ত্রী কী দারুণ কাজ করেছেন।” সদ্য জেলা দলের দায়িত্বে কিছু কাটছাঁটের পরে অরূপবাবু একটু কোণঠাসা। বাম-অভিযোগকে অবশ্য ‘অপপ্রচার’ বলে উড়িয়ে দিতে ছাড়ছেন না।
যাবতীয় বিরোধী-প্রশ্ন উড়িয়ে দিলেও তৃণমূলের কাছে যেটুকু কাঁটা আছে, সেটা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই। রাজীববাবু অবশ্য বলছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আর প্রতীক দিয়ে ভোট হবে। ও সবে কিছু এসে যাবে না।” তবু তৃণমূলের অন্দরেই হাওড়ার গোষ্ঠী-লড়াই নিয়ে চর্চা বিস্তর। দলের এক প্রথম সারির নেতার উদ্বেগ, “বিজেপি বা কংগ্রেস যদি কিছু ওয়ার্ডে কয়েকশো ভোটও কেটে দেয় আর তৃণমূল কর্মীরা বিভক্ত থাকেন, তা হলে কোনও কোনও জায়গায় অন্য রকম কিছু ঘটবে না, কে বলবে!” সেই ‘অন্য রকমে’ অবশ্য বৃহত্তর ছবি বদলে যাওয়ার আশঙ্কায় নেই তৃণমূল। ‘নবান্নে’র রানওয়ে থেকেই লোকসভা ভোটের মসৃণ উড়ান শুরু করে দিতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। |