প্রবন্ধ ২...
বাজারকে কাজ করতে দিন, দুর্নীতি কমবে
গের লেখাটিতে (‘অপরাধী, আমলা, রাজনীতিকের দুষ্টচক্র’, ৬-১১) আমি খুচরো দুর্নীতি এবং বড় দুর্নীতির মধ্যে তফাত করেছিলাম। খুচরো দুর্নীতি সাধারণত বেশি হয় নানা ধরনের পণ্য ও পরিষেবার সরকারি সরবরাহের ক্ষেত্রে। ১৯৯৭ সালে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে তিনটি বিষয়ে প্রশাসনিক সংস্কারের উপরে জোর দেওয়া হয়েছিল: (১) প্রশাসনকে দায়বদ্ধ ও নাগরিকের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন করে তোলা, (২) স্বচ্ছতা এবং তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করা এবং (৩) দুর্নীতির মোকাবিলায় প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্তা ও কর্মীদের তৎপর করা। কেন্দ্রীয় সরকারও এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগী হয়েছে। পরিবহণ, পুলিশ, জল সরবরাহ, জমির বেচাকেনা ইত্যাদি যে সব ক্ষেত্রে নাগরিকদের বিশেষ ভাবে সরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভর করতে হয়, সেগুলিকে প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সরকারি প্রশাসন ও পরিষেবার দুর্নীতির ফল সকলের পক্ষে সমান নয়। আর্থিক সংগতি যাঁদের কম, এই দুর্নীতি তাঁদের পক্ষে বেশি ক্ষতিকর। রিকশা চালক, হকার, দোকানদার ইত্যাদি বর্গের মানুষকে কত ঘুষ দিতে হয়, তার নানা হিসেব কষা হয়েছে। সংখ্যাগুলো ভয়ানক। বিশ্বব্যাঙ্ক একটা সূচক তৈরি করেছে: ডুয়িং বিজনেস ইন্ডিকেটরস, অর্থাৎ ব্যবসা চালানোর পরিবেশ সংক্রান্ত সূচক। বিভিন্ন দেশে নিয়মিত সমীক্ষা করে এই সূচক হিসেব করা হয়। নিয়মকানুন মেনে ছোট বা মাঝারি মাপের কারখানা বা ব্যবসা গড়তে এবং চালাতে এক জন উদ্যোগীকে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়, এই সূচক তৈরি হয় তার ভিত্তিতে। একটা উদ্যোগের জন্য বিভিন্ন পর্বে দশটি জরুরি কাজ থাকে: উদ্যোগ শুরু করা, কারখানা বা ব্যবসাকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকারি বা পুর অনুমোদন জোগাড় করা, বিদ্যুৎ সংযোগের বন্দোবস্ত, সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশন, ঋণের ব্যবস্থা, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার আয়োজন, কর মেটানো, আমদানি ও রফতানি, চুক্তি বলবৎ করা এবং আর্থিক সংকটের মোকাবিলা। এ দেশে এর প্রত্যেকটি পর্যায়ে প্রায়শই বাড়তি টাকা দিতে হয়, অনেক সময়েই ঘুষ ছাড়া কাজ এগোয় না।
প্রতিযোগিতা। এই বাজার যদি নিয়ন্ত্রিত হত? ছবি: এ এফ পি।
অর্থনীতিবিদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসু এক বার একটা কথা বলে খুব শোরগোল তুলেছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘুষ ‘দেওয়া’কে বেআইনি কাজ বলে গণ্য করা ঠিক নয়। যেখানে ন্যায্য প্রাপ্য পাওয়ার জন্য ঘুষ দিতে হয়, না দিলে তা পাওয়া যায় না, সেখানে অসহায় উপভোক্তাকে ঘুষ দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা উচিত নয়, এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। অনেকেই তাঁর খুব নিন্দা করেছিলেন যে, তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে বলছেন। কিন্তু কথাটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। এই ধরনের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কতকগুলো বড় কারণ থাকে। যেমন, স্পষ্ট ও যথাযথ নিয়মকানুনের অভাব, নিয়ম বলবৎ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি, প্রশাসনিক এবং বিচারবিভাগীয় পরিকাঠামোর অভাব, যথাযথ তদারকির অভাব, যাঁরা প্রশাসন চালান এবং যাঁরা তদারকি করেন তাঁদের যথেষ্ট বেতন ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার অভাব ইত্যাদি। তবে একটা মৌলিক কারণ হল অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং তার ফলে সরকারি আধিকারিকদের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা। এটা থাকলেই ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এ থেকেই বোঝা যায়, দুর্নীতি কমানোর জন্য কী করা উচিত। কয়েকটি প্রধান পদক্ষেপের কথা বলা যাক।
এক, সরকারি প্রশাসনের কাঠামো সংস্কার করা দরকার। আধিকারিকদের আচরণবিধি, বেতন কাঠামো, নিয়োগ এবং পদোন্নতির নিয়ম, দুর্নীতি রোধের বন্দোবস্ত, সবই এর মধ্যে পড়বে। দুই, দুর্নীতি নিবারণের স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন আয়োজন থাকা দরকার। তিন, যে সব পরিষেবা সরবরাহের অধিকার সরকার পুরোপুরি নিজের হাতে রেখেছে, যথাসম্ভব সেগুলি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া। চার, খাদ্য বা অন্যান্য পণ্য সংগ্রহের সরকারি ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করে তোলা। পাঁচ, সরকারি ব্যবস্থার দুর্নীতি রোধে নাগরিক সমাজকে ওয়াকিবহাল ও তৎপর করা।
কোনও নাগরিক বা সংস্থা দৈনন্দিন নানা কাজে নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি হয় এবং সেখানেই খুচরো দুর্নীতির শিকার হয়। এক দিকে সরবরাহের ঘাটতি, অন্য দিকে অফিসার বা কর্মীদের বিশেষ ক্ষমতা এই দুইয়ের ফলে দুর্নীতির প্রসার ঘটে। ভারতের শহরগুলিতে অনেক ঘাটতি এখন বহুলাংশে মিটে গেছে, কিন্তু গ্রামের দিকে এখনও ঘাটতি প্রবল। যেমন জল, বিদ্যুৎ, রান্নার গ্যাস ইত্যাদির জোগান এখনও বহু জায়গাতেই প্রয়োজনের তুলনায় কম, বিশেষত দরিদ্রদের ক্ষেত্রে। বাজারের নিয়ম হল, ঘাটতি থাকলে দাম বাড়বে। কিন্তু দাম যদি বাড়ানো না যায়, তা হলে রেশন করতে হবে। রেশন মানে হল, যাঁরা প্রচলিত দামে পণ্য বা পরিষেবা কিনতে পারেন, তাঁদের সবাই তা পাবেন না, অন্তত পুরোটা পাবেন না। এমনিতে রেশন বলতে কী বোঝায়, আমরা জানি। কিন্তু স্বাভাবিক রেশন ছাড়াও আছে অস্বাভাবিক রেশন। প্রভাব খাটিয়ে বা ঘুষ দিয়ে কোনও পণ্য বা পরিষেবা জোগাড় করলে সেটাও এক ধরনের রেশন ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেই রেশনিং সরকারি নিয়মে চলে না, চলে দুর্নীতির বেনিয়মে।
আমাদের দেশে খাদ্য ভর্তুকি এবং সরকারি বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। তার পুনরাবৃত্তির কোনও দরকার নেই। মোদ্দা কথা হল, এই ব্যবস্থাটির মধ্যে বাজারের প্রতিযোগিতাকে যত বেশি আনা যাবে, দুর্নীতি তত কমবে। সরাসরি ভর্তুকি হস্তান্তর-এর প্রস্তাব ঠিক ভাবে কার্যকর করা গেলে সেই পথে এগনো সম্ভব। তবে এর পরেও আইনি জটিলতার কারণে দুর্নীতির সম্ভাবনা থেকেই যায়। যেমন, প্রত্যক্ষ কর এবং পরোক্ষ কর, দুইয়ের ক্ষেত্রেই আইন আগের তুলনায় সরল ও স্বচ্ছ হয়েছে বটে, কিন্তু এখনও নানা ধরনের ছাড় এবং রেহাইয়ের জটিলতা আছে। তার ফলে অনেকে কর ফাঁকি দেওয়ার নানা ছল খোঁজেন, সেই রন্ধ্র দিয়ে দুর্নীতি প্রবেশ করে। এই সব জটিলতা যদি দূর করা যায় এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কর ফাঁকি দেওয়ার মাসুল যদি যথেষ্ট বাড়ানো যায়, তা হলে দুর্নীতি কমবে।

• বাজারের ঘাটতি, অহেতুক নিয়ন্ত্রণ এবং জটিল আইন, এই ত্র্যহস্পর্শে এ দেশে
দুর্নীতির এমন বাড়বাড়ন্ত। তার ফল সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় গরিব মানুষকেই।
• দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.