আমার লেখার (‘সর্দার পটেল...’, ৬-১১) প্রেক্ষিতে তথাগত রায়ের চিঠি (‘দেশভাগ এড়ানোর সুযোগ...’, ১৪-১১) পড়লাম। এই বিষয়ে আমার বক্তব্য, প্রথম ক্যাবিনেট মিশন প্রকল্প ‘প্রায় সম্পূর্ণ’ই ভেস্তে দেওয়ার দায় একা নেহরুর নয়। ‘প্রায় সম্পূর্ণ’ কারণ, পুরোটা ভেস্তে যায়নি। ক্যাবিনেট মিশনের প্রধান তিনটি প্রস্তাব ছিল এক, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন। দুই, সংবিধান প্রণয়নের জন্য নির্বাচিত গণপরিষদ গঠন। তিন, দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকার এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাদেশিক সরকারগুলির ‘গ্রুপিং’ তৈরি করা। কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র বিদেশ, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ দফতর থাকবে। বাকি সমস্ত ক্ষমতা রাজ্যগুলির স্বেচ্ছাধীন ‘গ্রুপিং’-এর উপর ন্যস্ত হবে। এটি হল এক প্রকার সিভিল কনফেডারেশনের ধারণা। মিশন ডেলিগেশনে কংগ্রেস প্রতিনিধি দলের নেতা তথা সভাপতি মৌলানা আজাদ এতে সম্মত হন। মুসলিম লিগও প্রাথমিক ভাবে মেনে নেয়। এটি ১৬ মে ১৯৪৬-এর প্রস্তাব।
কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ১৬ জুনের প্রস্তাবটি কংগ্রেসের পক্ষে ‘সম্পূর্ণ’ মানা সম্ভব হয়নি। এখানে ‘গ্রুপিং’-এর ধারণাকে প্রসারিত করে স্পষ্টতই ‘হিন্দু ভারত’ ও ‘মুসলিম ভারতে’ ভাগ করা হয়। মুসলিম লিগকে খুশি করার জন্যই ওই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ২৫ জুন ১৯৪৬ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, অন্তর্বর্তী সরকার ও গণপরিষদ গঠন ছাড়া বাকি প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। কংগ্রেস তার জাতীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র হারাতে পারবে না। ১০ জুলাই সাংবিধানিক সম্মেলনে নেহরু ওয়ার্কিং কমিটির ওই সিদ্ধান্তই বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেন। এতে জিন্নাহ্-র ধৈর্যচ্যুতি হলে তার দায় নেহরুর একার নয়। |
এর পরেও সুযোগ ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারে (২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬) লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় মুসলিম লিগ নেতা যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস যেহেতু ‘গ্রুপিং’ ফর্মুলায় রাজি ছিল না, তাই জিন্নাহ্ কিছুতেই গণপরিষদে যোগ দিলেন না। তাঁর হাতিয়ার হল ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৬-এ ব্রিটিশ সরকারের ঘোষণা যে, ভারতীয় গণপরিষদ প্রণীত ব্যবস্থা সারা দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে পৃথক গণপরিষদ হবে। তাই হল। দেশভাগ তাই এড়ানো গেল না। ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবিত সিভিল কনফেডারেশনের ও দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি শ্রীরায়ের সমর্থন এবং নরেন্দ্র মোদী কল্পিত সবল কেন্দ্রীয় সরকার ও অখণ্ড ভারতের ধারণার বিরোধ চোখে পড়ার মতো।
দ্বিতীয়ত, শ্রীরায় লিখেছেন, মৌলানা আজাদের মতে, ‘উনি যদি কংগ্রেস সভাপতি পদ ছাড়ার সময় নেহরুর নাম প্রস্তাব না-করে পটেলের নাম প্রস্তাব করতেন...’ কী আশ্চর্য! ১৬ মে-র প্রস্তাবে সম্মত হলেও ১৬ জুনের প্রস্তাব তো আজাদও মেনে নিতে পারেননি। আজাদ কংগ্রেসের দায়িত্ব সামলেছেন ১৯৪০ থেকে ১৯৪৬। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রাক্কালে সাময়িক ভাবে নেহরু সভাপতি। এর পর ক্ষমতা হস্তান্তর অবধি সবচেয়ে কঠিন সময়ে কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন আচার্য কৃপালনী। তাঁর কথা শ্রীরায় ভুলে গেলেন?
তৃতীয়ত, অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন ছিলেন মাউন্টব্যাটেনের ব্যক্তিগত সচিব ও ছায়াসঙ্গী। তিনি ও মাউন্টব্যাটেন উভয়েই সর্দার পটেলের একান্ত গুণগ্রাহী ছিলেন। শুধু ওই বইতে নয়, একাধিক সাক্ষাৎকারে অ্যালান ক্যাম্বেল জনসন বলেছেন যে, ১৯৪৬-’৪৭ পর্বে অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়নে ও প্রশাসনিক পদক্ষেপে সর্দর পটেল অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। তাঁকে টপকে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত না। জনসন জানিয়েছেন, পটেল না-চাইলে দেশভাগও সম্ভব করা যেত না।
চতুর্থত, কাশ্মীর প্রসঙ্গ। দুর্গা দাস সম্পাদিত সর্দার পটেল’স করেসপন্ডেন্স’-এর প্রথম খণ্ডটি একটু ওলটালেই হবে। ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ পটেলকে লেখা নেহরুর চিঠিটি গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে নেহরু কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং অবিলম্বে হরি সিংহের ভারতভুক্তির কথা বলেছেন। নেহরু বুঝেছিলেন কাশ্মীর সমস্যা হায়দরাবাদের তুলনায় জটিলতর। অথচ পাক হানাদারেরা শ্রীনগরের কাছাকাছি না-আসা অবধি পটেল হরি সিংহকে শর্তসাপেক্ষে রাজি করাতে পারলেন না। কিন্তু নেহরুকে উপেক্ষা করেই নাকি হায়দরাবাদে সেনা চলে গিয়েছিল। মাউন্টব্যাটেন অসত্য বলেননি বলেই মনে হয়। নেহরু বা পটেলের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই।
পঞ্চমত, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এ বিষয়ে তো মোদীই কিছু বলছেন না। হ্যাঁ, কাশ্মীর প্রসঙ্গে নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতায় মন্ত্রিত্ব ছাড়েন গণপরিষদের প্রাক্তন সদস্য শ্যামাপ্রসাদ। জনসংঘ গঠনের পর কাশ্মীরের সম্পূর্ণ ভারতভুক্তির পক্ষে সওয়ালও করেন সংসদের ভিতরে ও বাইরে। তবু জম্মুতে হিন্দুত্ববাদী প্রজাপরিষদ ও জনসংঘের উগ্রবাদীরা যখন সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ, প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্নে দিল্লি সমঝোতার বিরোধিতায় প্রবল আন্দোলন করছে, শেখ আবদুল্লা-সহ উপত্যকার নেতারা তাতে আপত্তি জানান। নেহরু শ্যামাপ্রসাদের শরণাপন্ন হন। ১৯৫৩-র ৫ ফেব্রুয়ারির পত্রে নেহরু শ্যামাপ্রসাদের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। শ্যামাপ্রসাদ ১৭ ফেব্রুয়ারি নেহরুকে লেখা পত্রে জানান যে, ৩৭০ ধারা, প্রাদেশিক স্বাতন্ত্র্য, দিল্লি সমঝোতা সবই তিনি সমর্থন করেন। এর পর কাশ্মীরের অনুপ্রবেশ পারমিটের বিরোধিতায় সেখানে গেলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কারান্তরালে এই বঙ্গসন্তানের মৃত্যু হয়। এ কথা ঠিক, শ্যামাপ্রসাদ জীবিত থাকলে প্রজাপরিষদ ও জনসংঘের উগ্রবাদীদের সংযত করতে পারতেন। তাঁর মৃত্যু কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথকে জটিল করে তুলল।
উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় |