পড়া চালিয়ে যাওয়ার শপথে বিয়ে রুখে দিল কিশোরী
নেরো বছরের কিশোরী পণ করেছিল, নিজের স্বপ্নকে কিছুতেই এত দ্রুত শেষ হতে দেবে না। কোনও মতেই হাল ছাড়বে না। অন্যায়ের প্রতিরোধ করবেই।
প্রথম দফার লড়াইয়ে সে সফল। মেয়ের রোখের কাছে হার মেনেছেন মা-বাবাও। নাবালিকা ভেস্তে দিয়েছে নিজের বিয়ে। রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দীদের মতো বিয়ে রুখে দেওয়া প্রতিবাদী কিশোরীদের তালিকায় নাম উঠেছে দমদম বেদিয়াপাড়া ঝিলকলোনির বাসিন্দা সুতপা দাসের (নাম পরিবর্তিত)।
সিঁথি রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ বিদ্যামন্দির ফর গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী সুতপা। ২০১৪ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। ২৮ নভেম্বর থেকে টেস্ট শুরু হচ্ছে তার। বাবা পেশায় গাড়িচালক। সুতপা একমাত্র সন্তান। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পড়াশোনায় উৎসাহ দেওয়ার বদলে অভিভাবকেরা তার বিয়ে ঠিক করে বসেছিলেন বলে অভিযোগ সুতপার। গ্রামগঞ্জ নয়, খাস কলকাতা শহরে থেকেও মেয়েদের একমাত্র গতি বিয়ে বলেই মনে করতেন তাঁরা। ফলে দমদম থানার এক কর্মীর ছেলের সঙ্গে নভেম্বরের মাঝামাঝি বিয়ে পাকা করে দেন মেয়ের।
কিন্তু হার মানেনি সুতপা। বলে, “আমি ঠিক করেছিলাম পড়াশোনা করে এয়ারফোর্সে চাকরি করব। এত তাড়াতাড়ি কিছুতেই বিয়ে করব না। ১৮ বছরের নীচে বিয়ে দেওয়া বেআইনি। মা-বাবা-জেঠাকে অনেক বুঝিয়েও লাভ হল না। তখন স্কুলের কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করলাম। সকলে মিলে ইন্টারনেট ঘেঁটে বার করলাম রাজ্য মহিলা কমিশনের ঠিকানা। একটি চিঠিতে সব লিখে সাহায্য চেয়ে ক্যুরিয়রে পাঠিয়ে দিলাম কমিশনে।” মহিলা কমিশন সূত্রের খবর, গত ২৯ অক্টোবর তারা সুতপার চিঠি পায়। ৪ নভেম্বর বিষয়টি জানায় উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা সমাজকল্যাণ অফিসার মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়কে এবং বারাসতে মহকুমা শাসকের অফিসে। ৬ নভেম্বর জানানো হয় ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে। ৮ নভেম্বর খবর দেওয়া হয় উত্তর ২৪ পরগনা শিশুকল্যাণ সমিতি (সিডব্লিউসি)-কে।
বিয়ের কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছে বুঝতে পেরেই সতর্ক হন অভিভাবকেরা। বেঁকে বসেন হবু শ্বশুরমশাইও। কারণ, নাবালিকাকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকলে দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে তাঁর। তার উপরে এটি একটি জামিন-অযোগ্য অপরাধ। তিনি সরকারি কর্মচারী। নাবালিকার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে চাকরি নিয়েও টানাটানি হতে পারে আশঙ্কা করে পিছিয়ে আসেন তিনি। ভেঙে যায় বিয়ে।
সুতপার কথায়, “শেষ পর্যন্ত পরীক্ষাটা দিতে পারছি। খুব খুশি আমি। মা-বাবা বলছেন, আপাতত আর আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দেবেন না। দিলে আমি আবার অভিযোগ করে চিঠি পাঠিয়ে দেব।” তার বাবা মঙ্গল দাসের বক্তব্য, “আমাদের অবস্থা ভাল নয়। পরিস্থিতির চাপ ছিল বলেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিলাম। মেয়ে যখন চাইছে না, আর চাপ দেব না। এ নিয়ে এত চেঁচামেচির কী আছে?”
তবে এই লড়াইয়ে সাহায্য চেয়ে চিঠি দিলেও ওই কিশোরী যে প্রশাসনিক তরফে আসলে কোনও সাহায্যই পায়নি, তা কার্যত স্বীকার করছে রাজ্য মহিলা কমিশন থেকে শুরু করে রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতর এবং সিডব্লিউসি। অভিযোগ যে দিন জমা পড়েছে সেই ২৯ অক্টোবর থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক মাস সুতপার অভিযোগ নিয়ে প্রশাসনের কোনও তরফেই কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “সুতপা নিজের জোরে বিয়ে ঠেকিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যদি জোর করে তার বিয়ে দেওয়া হত, এর দায় আমরা এড়াতে পারতাম না।” তাঁর বক্তব্য, “কমিশনের ক্ষমতা বলতে সংশ্লিষ্ট সব মহলে বিষয়টি জানিয়ে তাঁদের ব্যবস্থা নিতে বলা। তা আমরা করার পরেও কেউ এগিয়ে আসেনি।”
প্রশাসনিক গাফিলতির নমুনাটা ঠিক কী রকম?
প্রথমত কোনও জেলায় জোর করে নাবালিকার বিয়ের অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নোডাল অফিসার হলেন জেলা সমাজকল্যাণ অফিসার বা ডিএসডব্লিউও। তিনি অবিলম্বে এফআইআর করবেন এবং মেয়েটিকে সিডব্লিউসি-র কাছে নিয়ে যাবেন। এ ক্ষেত্রে সেই ডিএসডব্লিউও মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায় কিছুই করেননি বলে অভিযোগ। মণিশঙ্করবাবুর কথায়, “আমি মেয়েটির বাড়িতে লোক পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়েটিকে তখন মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়!” প্রশ্ন করা হয়, তা হলে মামাবাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা হল না কেন? তাঁর উত্তর, “মামাবাড়ির ঠিকানা জোগাড় করা যায়নি!” থানায় জানানো হল না কেন? তিনি দাবি করেন, “দমদম থানায় জানিয়েছি।” দমদম থানা অবশ্য এই দাবি মানতে চায়নি।
জেলার চাইল্ড ম্যারেজ প্রোটেকশন অফিসার উশ্রী রায়ের বক্তব্য, “আমি কোনও তরফ থেকে এই ঘটনা সম্পর্কে এতদিন কিছুই জানতে পারিনি।” জেলা সিডব্লিউসি-র কার্যনির্বাহী চেয়ারপার্সন রঞ্জনা ভৌমিক আবার জানান, তাঁদের অফিসের কোনও পিওন নেই বলে পুলিশের কাছে খবর পাঠিয়ে মেয়েটিকে ডেকে আনাতে পারেননি! কোনও ব্যবস্থা নেয়নি ব্যারাকপুর কমিশনারেটও।
খাস কলকাতায় এক কিশোরীর বিয়ে আটকাতে যদি সরকার ও প্রশাসন এতটা উদাসীন হয় তা হলে গ্রামাঞ্চলের কী অবস্থা, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। যেখানে মূলত নাবালিকাদের বিয়ে আটকানোর লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কন্যাশ্রী’র মতো প্রকল্প শুরু করেছেন, সেখানে প্রশাসনের সর্বস্তরের সাহায্য না পেলে এই লক্ষ্যে কতদূর সফল হওয়া সম্ভব?
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.