দেশি আর বিদেশির মিশেলে তৈরি নতুন ধরনের শুয়োর চাষ করিয়ে পুরুলিয়ার গ্রামীণ অর্থনীতির পরিবর্তন আনতে চাইছে রাজ্য সরকার। রাঁচির বীরসা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী শান্তকুমার সিংহের তৈরি করা ‘ট্যামওয়ার্থ এন্ড দেশি’ নামের এই সঙ্কর প্রজাতির শুয়োর পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের গ্রামে বিলি করছে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অধীন সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ। পর্ষদের চেয়ারম্যান শুভাশিস বটব্যাল বলেন, “দেশি শুয়োরের তুলনায় এই সঙ্কর প্রজাতির শুয়োর চাষে অনেক লাভ। ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, অসম, মেঘালয়, ছত্তিসগঢ়ের মতো রাজ্যগুলি ওই শুয়োর চাষ করে সুফল পেয়েছে। তাই আমরাও যাঁরা শুয়োর পালন করেন, তাঁদের এই প্রজাতির শুয়োর শাবক দিচ্ছি।”
রাঁচির ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ ‘কলেজ অব ভেটেনারি সায়েন্সেস অ্যান্ড অ্যানিম্যাল হাজব্যান্ডি’র অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস বিভাগে ১৯৮৯ সালে প্রথম এই শুয়োরের জন্ম দেন শান্তকুমার। তিনি বলেন, “উন্নত সঙ্কর প্রজাতি শুয়োর তৈরির জন্য আমেরিকা ও ডেনমার্ক থেকে শুয়োর এনে প্রচুর গবেষণা করি। কিন্তু প্রত্যাশা মাফিক ফল মেলেনি। পরে ইংল্যান্ডের হ্যাম্পশায়ার, ইয়র্কশায়ার, বার্কশায়ার থেকে ‘ট্যামওয়ার্থ’ প্রজাতির সোনালি রঙের শুয়োর আনিয়ে দেশি শুয়োরের সঙ্গে মিলন ঘটাই। তাতেই এই সঙ্কর প্রজাতির শুয়োরের জন্ম হয়।” তিনি জানান, সেই শুয়োরের গায়ের রঙে মিশ্র প্রভাব পড়ে। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকায় যাঁরা শুয়োর পালন করেন, তাঁরা কালো শুয়োর পছন্দ করেন। পরবর্তী কালে আরও পরীক্ষা চালিয়ে তিনি ওই সঙ্কর প্রজাতির কালো রঙের শুয়োর তৈরি করেন। শান্তকুমারকে নিয়ে এসে অযোধ্যা পাহড়তলির গ্রামবাসীদের এই শুয়োর চাষ কতটা লাভজনক তা বোঝালেন সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের কর্তারা। |
ওই বিজ্ঞানীর জানালেন, এক বছরের একটি দেশি শুয়োরের ওজন বড়জোর ৪০ কেজি হয়। সেই তুলনায় ওই সঙ্কর প্রজাতির শুয়োরের ওজন ওই বয়সে ৮৫ কেজি পর্যন্ত হয়। দেশি শুয়োর যেখানে এক বছরে একবার বাচ্চার জন্ম দেয়, সেখানে সঙ্কর প্রজাতির এই শুয়োর বছরে দু’বার প্রসব করে। তা ছাড়া এই প্রজাতির শুয়োর পালনের ঝামেলাও অনেক কম। এরা রোগে ভোগে কম। চর্মরোগও কম। সেই সঙ্গে এদের খাবার নিয়েও পালকদের চিন্তায় থাকতে হয় না। ঘাস, হোটেল-রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া খাবার, বাতিল হয়ে যাওয়া শাক-সব্জিও চেটেপুটে খেয়ে নেয়। খরচ যেমন কম, তেমনি লাভও অনেক বেশি। শান্তকুমার বলেন, “এই শুয়োরের মাংস সুস্বাদু বলে দেশের বাজার তো বটেই, আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। তাই দেশি শুয়োরের তুলনায় এই সঙ্কর প্রজাতির শুয়োর চাষ করে দ্বিগুন লাভ করা যাবে।” সামগ্রিক অঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের কর্তারা জানাচ্ছেন, এই প্রজাতির একটি শুয়োর ১৩টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। কিন্ত বাজারে চাহিদার তুলনায় শুয়োরের ভাল মাংসের জোগান অনেক কম। ওই শুয়োর বিক্রি করতে সমস্যায় পড়লে সংস্থাই পালকদের সে ব্যাপারে সহায়তা করবে বলে তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন।
অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে বেগুনকোদরের সাহারজোড় প্রকল্পে এ রাজ্যে প্রথম এই শুয়োরের প্রজনন ও প্রতিপালন কেন্দ্র চালু হয়েছে। ওই কেন্দ্রের আধিকারিক নিত্যানন্দ চক্রবর্তী বলেন, “এই প্রজাতির শুয়োরের প্রজনন ক্ষমতা বেশি। কলেরা, এঁসো, রক্তাল্পতা, ইপিসেপালাসের মতো রোগ এঁদের সহজে হয় না। তাই চিকিৎসার খরচও কম। কয়েকটি টিকা দিলেই হবে।” সংস্থার এক আধিকারিক কাঞ্চনকুমার ভৌমিক বলেন, “গমের ভূষি, ঝোলা গুড়, ভাতের ফ্যান ও দেশি মদ তৈরির পর যে চালটা পড়ে থাকে, তা এদের আদর্শ খাবার।”
ঝাড়খণ্ডের রাঁচির বাসিন্দা প্রাক্তন সেনাকর্মী উমেশকুমার সিংহ এই প্রজাতির শুয়োর প্রতিপালন করছেন। তাঁর কথায়, “টি এন্ড ডি প্রজাতির শুয়োর চাষ করা অত্যন্ত লাভজনক। খুব কম অর্থ বিনিয়োগ করে বেশি লাভ পাওয়া যায়। এক একটি বাচ্চার দাম পড়ে কমবেশি ২০০০ টাকা। এক বছরেই প্রচুর লাভ করা যায়।” শান্তকুমারের ‘ক্লাস’ করে এই নতুন প্রজাতির শুয়োর চাষে উৎসাহিত হয়ে পড়েছেন ঝালদা ২ ব্লকের বলরামপুর গ্রামের পদক সোরেন, রামপদ মাঝি, লক্ষ্মীমণি মাঝি থেকে রামপুর গ্রামের অশোক গড়াত, ভীষ্ম গড়াতরা। তাঁরা বলেন, “আমরা দেশি শুয়োর পালন করি। এ বার থেকে সঙ্কর প্রজাতির শুয়োর চাষ করব।”
|
সঙ্করে বাড়তি সুবিধে |
• দেশি শুয়োরের চেয়ে আকারে বড়, ওজনেও বেশি।
• দেশি শুয়োরের তুলনায় প্রজনন ক্ষমতা প্রায় দু’গুণ।
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও জোরালো।
• মাংসের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারেও, দামও বেশি।
• পালনে বাড়তি খরচ নেই। |
|