জরুরি বিভাগ পেরিয়ে বাঁ দিকে ঘুরতেই থমকে যেতে হল। করিডরের মেঝেতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। রোগীর পরিজন থেকে শুরু করে চিকিৎসক, কর্মীরা সকলেই রক্ত বাঁচিয়ে একপাশ দিয়ে সর্ন্তপণে যাতায়াত করছেন। অসাবধানতাবশত কেউ বা কারা হয়ত আগে রক্তে মাড়িয়েই চলে গিয়েছেন। রক্ত মাখা জুতোর ছাপ করিডর জুড়েই। সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের কিছুটা দূরে ‘মহিলা জরুরি ওয়ার্ডে’ ঢোকার মুখে এমনই দৃশ্য দেখা গেল।
রোগীর পরিজন এবং কর্মীদের থেকে জানা গেল, এ দিন সকালে জরুরি বিভাগে স্ত্রী রোগে আক্রান্ত এক মহিলাকে ভর্তি করানো হয়। সে সময়েই মহিলার শরীর থেকে বেরনো রক্ত স্ট্রেচার থেকে মেঝেতে পড়ে।
দুপুর একটা, মেঝের রক্ত জমাট বেধে কালচে হয়ে গিয়েছে। পাশেই রোগীর পরিজনদের বসার চেয়ারের সারি। রক্তের উপর মাছি ভনভন করছে। এক রোগীর আত্মীয় অনুসন্ধান কেন্দ্রে অভিযোগ জানিয়ে এলেন। প্রায় এক ঘণ্টা পরে, দুপুর আড়াইটে নাগাদ পরিস্থিতির খানিকটা পরিবর্তন দেখা গেল। কেউ এসে রক্তের উপর জল ঢেলে গিয়েছেন। করিডর জুড়েই সেই রক্তমাখা জল গড়াচ্ছে। |
দুপুর সাড়ে তিনটে। কালচে হয়ে যাওয়া রক্ত করিডরে একই অবস্থায় পড়ে রয়েছে। জল শুকিয়ে যাওয়ায় ফের মাছির দল উপস্থিত হয়েছে রক্তের উপরে।
বিকেল নাগাদ অন্য রকম সমস্যা তৈরি হল মেডিসিন ওয়ার্ডে। শিলিগুড়ি লাগোয়া এলাকার এক বাসিন্দা শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি রয়েছেন। বারান্দার দরজা গলে কটূ গন্ধ ভরা ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করায় তিনি, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কর্তব্যরত নার্সকে জানাতে, তিনি দরজাটি ভেজিয়ে দিলেন। যদিও, দরজার ফাঁক গলে ধোঁয়ার গন্ধ আটকানো সম্ভব হল না। দেখা গেল, মেডিসিন বিভাগের করিডরের পাশে জমে রয়েছে চিকিৎসা বর্জ্যের স্তূপ। রক্তের পাউচ, প্লাস্টিকের নল, সিরিঞ্জ, স্যালাইনের প্লাস্টিক বোতল ছড়িয়ে রয়েছে। সেই স্তূপেই আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন কেউ। প্লাস্টিক পোড়া ধোঁয়া অর্নগল ঢুকছে মেডিসিন ওয়ার্ডের ভিতরে। শুরু হয়েছে রোগীদের দুর্ভোগ। অভিযোগ, প্রতিদিনই বিকেলে কড়িডর ছুঁয়ে থাকা বর্জ্যের স্তূপে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।
শুধু মেডিসিন ওয়ার্ড নয়, প্রসূতি বিভাগ, পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ড, সার্জিকাল ওয়ার্ড সর্বত্রই করিডরের পাশে স্তুপাকৃতি চিকিৎসা-বর্জ্যের স্তূপ। মেডিক্যালেরই এক চিকিৎসক জানালেন, “ব্লাড ব্যাগ, সিরিঞ্জ বা অনান্য চিকিৎসা বর্জ্য পোড়ার ধোঁয়া অত্যন্ত বিষাক্ত। যে রোগীর শ্বাসকষ্ট নেই, তিনিও সংক্রমিত হতে পারেন।” মডিক্যাল কলেজের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “এই দুটোই মারাত্মক অভিযোগ। কর্তৃপক্ষকে নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে।”
কেন এই অবস্থা?
মেডিক্যাল কলেজের সুপার সব্যসাচী দাস বলেন, “চিকিৎসা বর্জ্য যেখানে সেখানে থাকার কথা নয়। একটি সংস্থা নিয়মিত তা নিয়ে যায়। আর ওয়ার্ডের পাশে বর্জ্যে আগুন লাগানো উচিত নয়। কারা এ ধরণের ঘটনা ঘটাচ্ছেন খোঁজ নেব। পাশাপাশি কেন দিনভর করিডরের মেঝেতে রক্ত পড়ে থাকল তা জেনে, ব্যবস্থা নেব।”
বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তথা শিলিগুড়ির বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “এটা কর্মসংস্কৃতির বিষয়। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করব।” মাটিগাড়ার বিধায়ক কংগ্রেসের দার্জিলিং জেলার (সমতল) সভাপতি শঙ্কর মালাকার জানান, তিনিও এই সমস্যা সমাধানে বৈঠক করবেন।
এ দিন অবশ্য ছবির কোনও পরিবর্তন হয়নি। বিকেল সাড়ে চারটের সময় মেডিক্যাল কলেজ ছাড়ার সময়েও দেখা গেল জরুরি বিভাগের সামনের করিডরে রক্ত গড়িয়েই যাচ্ছে। আর মেডিক্যাল কলেজের লম্বা করিডরের বিভিন্ন কোণায় জঞ্জালের স্তূপ থেকে তখনও অনর্গল ধোঁয়া বের হয়েই চলছে। |