বছর এগারোর মেয়ের হাত ভেঙে গিয়েছে। নন্দকুমারের নামালক্ষ্যা গ্রামের রুকসানা বিবি তাই মেয়ে মনিরাকে নিয়ে সোমবার সাত সকালে তমলুক জেলা হাসপাতালে চলে এসেছিলেন। বহির্বিভাগের সামনে এক ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষার পর সকাল ৯টা নাগাদ দরজা খুললে অস্থি বিভাগে ২ টাকা দিয়ে ‘স্লিপ’ কাটেন তিনি। কিন্তু অস্থি বিভাগে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। কারণ ছাড়াই ওই বিভাগ বন্ধ থাকার নোটিস সাঁটানো দরজায়।
শুধু রুকসানা বিবি নন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা হাসপাতালের বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবায় নাকাল এমন আরও অনেকে। হতছন্ন অন্তর্বিভাগও। চারদিকে জঞ্জাল, পানের পিক পড়ে। প্রসূতি বিভাগে সার দিয়ে মেঝেয় শুয়ে রয়েছেন রোগীরা।
এ দিন সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ তমলুক জেলা হাসপাতালের সামনে গিয়ে দেখা যায় বহির্বিভাগের মূল দরজার সামনে প্রায় একশোর বেশি মানুষ অপেক্ষা করছেন। ক্রমশ সেই ভিড় বাড়তে থাকে। জেনারেল, চর্ম ও যৌন, দন্ত, চক্ষু এবং সার্জিক্যাল বিভাগের চিকিৎসকরা কিছু সময়ের মধ্যে রোগী দেখা শুরু করলেও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক রোগী দেখা শুরু করেন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ। একই ভাবে এদিন বন্ধ ছিল আউটডোরের নাক, কান ও গলা বিভাগ। সেখানে চিকিৎসা করাতে এসে ফিরে যেতে হয়েছে কোলাঘাটের মাছিনান গ্রামের বাসিন্দা অর্জুন দাসকে। অর্জুনবাবু বলেন, “চার বছরের ছেলের কানের সমস্যা। চিকিৎসার জন্য কাজ বন্ধ করে এতদূর এলাম। আউটডোরে টিকিট কাটানোর সময়ও জানানো হয়নি আজ চিকিৎসক নেই। দেখাতে গিয়ে জানতে পারলাম আজ চিকিৎসক নেই। তাই বাধ্য হয়ে ফিরে যাচ্ছি।” অস্থিবিভাগ বন্ধ থাকায় এ দিন ফিরে গিয়েছেন ময়নার পরমানন্দপুর গ্রামের পলাশ বেরা, নন্দকুমারের চকশিমুলিয়া গ্রামের সুনীতা মাজী, নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়া গ্রামের দিলীপ বাগরা। ক্ষুদ্ধ সুনীতাদেবী বলেন, “হাসপাতালের বহির্বিভাগে একটা নোটিস দিয়ে দায় সারা হয়েছে। এতদূর থেকে জেলা হাসপাতালে এসেও চিকিৎসা করতে না পারলে আমরা যাব কোথায়? |
জেলা হাসপাতালের সুপার ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধায় বলেন, ‘‘অস্থি বিভাগের চিকিৎসক এদিন আত্মীয়ের বিয়ের জন্য ছুটি নেওয়ায় ওই বিভাগ বন্ধ ছিল। চিকিৎসক না থাকলে এ ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে ওই রোগীরা সার্জিকাল বিভাগেও গিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতেন। নাক, কান ও গলা বিভাগ খোলা ছিল বলেই আমি জানি।”
রোগীদের হাজারো অভিযোগ রয়েছে তমলুক জেলা হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ নিয়েও। জেলা হাসপাতাল ভবনের চত্বরে থাকা নিকাশিনালার বেশিরভাগ অংশে আবর্জনা ও পচা জল জমে রয়েছে। হাসপাতালের পুরনো ভবনের পাশেই প্রচুর আবর্জনা জমে। জেলা হাসপাতালে আসা পাঁশকুড়ার মাইশোরা এলাকার বাসিন্দা শেখ ইসমাইল বলেন, “হাসপাতাল চত্বরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছা করে না। জঞ্জাল সাফাই করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে মনে হয় না।” পুরনো ভবনের দোতলায় গিয়ে দেখা যায় দেওয়ালের কোণে-কোণে পানের পিক পড়ে। জেলা হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতালের চত্বর ও ভিতরে নিকাশি নালা, জঞ্জাল সাফাইয়ের জন্য একটি বেসরকারি ঠিকাদার সংস্থাকে নিয়োগ করা হয়েছে। এই খাতে প্রতি মাসে প্রায় ১ লক্ষ টাকা ৩০ হাজার টাকা খরচ করা হয়। ওই ঠিকাদার ঠিক মতো কাজ না করায় এই অবস্থা। আবর্জনা জমে থাকার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে জেলা হাসপাতালের সহকারী সুপার দিলীপ গিরি গোস্বামী বলেন, “হাসপাতালের ভিতরে ও বাইরে আবর্জনা সাফাইয়ের জন্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার কাজ নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। ইতিমধ্যে ওদের সতর্ক করা হয়েছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।”
এ দিকে, জেলা হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে অ্যান্টি নেটাল ও পোস্ট নেটাল বিভাগে ৩২টি করে মোট ৬৪টি শয্যা থাকলেও গড়ে প্রতিদিন ১৪০ থেকে ১৫০ জন প্রসূতি ভর্তি থাকেন। বাধ্য হয়েই প্রসূতিদের মেঝেয় শুইয়ে রাখতে হয়। আর ‘ফিমেল মেডিক্যাল’ বিভাগে ২১টি শয্যা থাকলেও গড়ে ৩০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। ফলে এখানেও কয়েকজন মহিলা রোগীকে মেঝেয় রাখা হয়েছে।
এখন দোতলায় শিশু বিভাগের ভবন সংস্কারের কাজ চলায় শিশুদের ‘ফিমেল সার্জিকাল’ বিভাগের সামনে বারন্দায় রাখা হয়েছে। হাসপাতালের একতলায় ‘মেল সার্জিক্যাল’ বিভাগের পেয়িং কেবিনের দরজা ভেঙে যাওয়ায় এক বছরের বেশি বন্ধ হয়ে পড়ে। ওই কেবিনে রোগী ভর্তি থাকলে প্রতি দিন ৬০ টাকা আয় হত। হাসপাতালের বার্ন ওয়ার্ডের মূল দরজার একটি কাঁচের দরজা এক বছরের বেশি হল ভেঙে রয়েছে। ফলে ওই ১৪ শয্যার ওয়ার্ডে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র চালু রাখা হলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। অত্যন্ত সংবেদনশীল ওই বিভাগে ভর্তি থাকা অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ বজায় রাখা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগ ও বার্ন ওয়ার্ডের সমস্যা নিয়ে সহকারী সুপার বলেন, “হাসপাতালের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজের জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। শীঘ্রই সমস্যা মিটবে বলে আশা করা হচ্ছে।” |