রোগ ধরা পড়ার আগেই মৃত্যু পাথর খাদান মজুরের বিধিলিপি
রোগ নিয়ে ফাইল চালাচালি হতে হতেই মারা গেল রোগী।
বীরভূমের তালবাঁধের বছর পঁয়তাল্লিশের মিচু মুর্মুর মৃত্যু পশ্চিমবঙ্গে সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত মানুষের সংকট স্পষ্ট করে দিয়েছিল গত বছরই। এখনও পাথর খাদানের শ্রমিকদের মৃত্যু অব্যহত। মিনাখাঁর তিনটি গ্রামে পাথর খাদানের শ্রমিকদের মৃত্যুর মিছিল তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সরকারি নিয়মের ফাঁসে অসুখ নির্ণয় হওয়ার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা শুরুই হচ্ছে না।
পাথর খাদানে যাঁরা কাজ করেন, পাথরগুঁড়ো ফুসফুসে জমা হয়ে একটি পাথুরে স্তর তৈরি হয়। ফলে শ্বাসবায়ু থেকে টেনে নেওয়া অক্সিজেনের রক্তে মিলে যাওয়ার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। শুরু হয় শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর। এর লক্ষণগুলি অনেকটা যক্ষ্মার মতো, তাই অনেক রোগীকেই ডাক্তাররা কেবল যক্ষ্মার চিকিৎসা করেন। মিচুর ক্ষেত্রে অবশ্য একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে (অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেল্থ অ্যাসোসিয়েশন অফ ঝাড়খণ্ড, সংক্ষেপে ‘ওশাজ’) উদ্যোগে ফুসফুসের এক্স রে প্লেট আহমেদাবাদের একটি সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠিয়ে রোগ নির্ণয় করা হয়। তারপরেই শুরু হয় চিঠি চালাচালির পালা।
ওশাজ বিষয়টি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি দিয়ে জানায়। আর একটি প্রতিলিপি পাঠানো হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে। ২৪ ফেব্রুয়ারি মানবাধিকার কমিশন রাজ্য সরকারকে একটি তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলে। মার্চ মাসে সরকারের তরফে চিকিৎসকদের একটি প্রতিনিধি দল বীরভূমের পাথর খাদানে যায়। কিন্তু তার আগেই মারা যান মিচু মুর্মু। ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, চিকিৎসার সুযোগও তিনি পাননি। একই ভাবে ক্ষতিপূরণ না পেয়ে মারা যান দেবু রাউতও।
পাথর খাদানের দৈনন্দিন বাস্তবতা। —নিজস্ব চিত্র।
শ্রমিকদের মধ্যে সিলিকোসিস ঠেকাতে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর বছর দুয়েক আগে ‘সিলিকোসিস কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ নেয়। তার প্রতিনিধিরা বীরভূমের পাথর খাদান এলাকায় ২৫ জনকে পরীক্ষা করে জানায়, ২২ জনের দেহে যক্ষ্মা ধরা পড়েছে। সিলিকোসিস পাওয়া যায়নি। শ্রমিক অধিকারকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবি, সিলিকোসিস নির্ধারণ করার জন্য আইএলও (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগাইজেশন) নির্ধারিত পদ্ধতি মানেনি ওই চিকিৎসক দল। একই বিতর্ক আবার দেখা দিয়েছে এ বছর। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে বীরভূমের পাথরখাদানে ফের সিলিকোসিস ‘রুখতে’ শুরু হয়েছে পাইলট প্রজেক্ট। বীরভূমের জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিক মণ্ডল জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত দু’টি মেডিক্যাল ক্যাম্পে জনা পঁচিশেক শ্রমিককে পরীক্ষা করা হয়েছে। কারওর দেহেই সিলিকোসিস মেলেনি। কিন্তু বীরভূমের আদিবাসী গাঁওতার নেতা সুনীল সোরেনের দাবি, নলহাটি ১, রামপুরহাট ১ ও মহম্মদবাজার ব্লকে যে পাথরখাদান কারখানাগুলি রয়েছে, তার ৩০-৪০ শতাংশ শ্রমিকই সিলিকোসিসে আক্রান্ত।
সরকারের তরফে সিলিকোসিস নির্ণয়ে অনিচ্ছা, অবহেলার অভিযোগ বারবারই উঠেছে। শ্রমিক আন্দোলনের অনেকে মনে করছেন, ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় এড়াতেই সিলিকোসিস নির্ণয় এড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। ওশাজ-এর তরফে শমিত কর জানান, পেশার কারণে রোগ হলে শ্রমিকদের আইনত ক্ষতিপূরণ এবং পূর্ণ বেতন-সহ চিকিৎসার পাওয়ার কথা। তার জন্য সুপারিশ করার কথা চিকিৎসকদেরই। কিন্তু চিকিৎসকেরা তা জানেন না, অথবা এড়িয়ে যান।
রয়েছে পরিকাঠামোর সমস্যাও। ইএসআই আইনেও পেশাগত রোগ নির্ণীত হলে শ্রমিকেরা ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। অথচ বীরভূমে কোনও ইএসআই হাসপাতাল নেই। আবার, এ রাজ্যে অধিকাংশ পাথর খাদান বেআইনি। শ্রমিকের কোনও স্বীকৃতি নেই। পেশাগত রোগের জন্য চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা, সে যে আদতে শ্রমিক, সেটা প্রমাণ করতেই তার কালঘাম ছুটে যায়। শমিতবাবুও জানান, বীরভূমের খাদান এলাকায় কার্যকরী করা হয়নি ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট ১৯৪৮ ও মাইনিং অ্যাক্ট ১৯৫২ও। ফলে পার পেয়ে যাচ্ছেন খাদান মালিকেরা।
এ সব সমস্যা সত্ত্বেও ১৯৯৬ সালে পশ্চিম মেদিনীপুরের চিঁচুড়গেড়িয়ায় অনেক আন্দোলনের পরে নাগরিক মঞ্চ ও অন্যান্য অধিকার মঞ্চের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ পেতে সমর্থ হয়েছিলেন সুরেন্দ্র খনিজ প্রাইভেট লিমিটেডের ১৬ জন শ্রমিক। নাগরিক মঞ্চের তরফে নব দত্ত বলেন, “সিলিকোসিস নির্ধারণ করার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। বুকের এক্সরে প্লেটে আইএলও রেটিং করে দেখতে হবে, সেখানে কোনও ‘সিলিকা এক্সপোজার’ রয়েছে কি না। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটি করা হয় না। ফলে অনেক চিকিৎসকই সেটিকে যক্ষ্মা বলে ভুল করেন। শ্রমিকের রোগ চিহ্নিত হয় না।”
ইএসআই হাসপাতালের চিকিৎসক তথা সিলিকোসিস ও অন্যান্য পেশাগত রোগের অভিজ্ঞ চিকিৎসক কুণাল দত্তের অভিজ্ঞতা, “সাধারণ ডাক্তারি কোর্সে সিলিকোসিসের মতো পেশাগত রোগ নিয়ে পড়ানোই হয় না। যদি বা ডাক্তাররা বুঝতে পারেন, পেশার কারণে সিলিকোসিস হয়েছে, তাঁরা সেটা দায়িত্ব নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জানাতেও দ্বিধা করেন। তাই শ্রমিকের পক্ষে লড়াই করাটা শক্ত হয়ে যায়।”
শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু বলেন, “আমরা সরকারে আসার পর পাথর খাদানের শ্রমিকদের নির্মাণ শ্রমিকের সুবিধা দিচ্ছি। পেশাগত রোগের জন্য আমরা একটি বোর্ড তৈরি করেছি, যদিও তা দুর্বল। কিন্তু ওই অঞ্চলে পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় আমরা ওঁদের চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামোযুক্ত হাসপাতাল তৈরি করতে এখনও পারিনি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.