এক লাফে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে আলুবীজের দাম। আলুর দামে রাশ টানতে রাজ্য সরকার যেমন দর বেঁধে দিয়েছে, বীজের দাম সামলাতেও একই রকম হস্তক্ষেপ চাইছেন চাষিরা।
আলু উৎপাদনে দেশে প্রথম সারিতে থাকলেও আলুবীজের জন্য রাজ্যের চাষিদের এখনও পঞ্জাবের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয়। এ ছাড়া, ভুটান থেকে কিছু বীজ ঢোকে উত্তরবঙ্গে। এ বার বিভিন্ন কারণে পঞ্জাবের আলুর চাহিদা লাফিয়ে বেড়েছে। তার একটি যদি হয় উত্তরপ্রদেশের মতো কিছু রাজ্যে বাড়তি চাহিদা, অন্যতম কারণ এই রাজ্য থেকে পড়শি রাজ্যগুলিতে বীজ আলু যেতে না দেওয়া। ফলে মরসুমের শুরুতেই পঞ্জাবের বীজের দাম চড়ে গিয়েছে। বহু জায়গায় টাকা দিয়েও বীজ মিলছে না। যা পরিস্থিতি, তাতে বহু চাষিই এ বার আলু চাষ না করার বা অন্তত চাষের এলাকা কমানোর কথা ভাবছেন।
অবস্থা সামাল দিতে চাষি ও আলুবীজ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারের বক্তব্য, “রাজ্যের উৎপাদিত আলুবীজ চাষিরা এখনও ব্যবহার শুরু করেননি। পঞ্জাবের আলুবীজের দাম নিয়ন্ত্রনে সরকারি হস্তক্ষেপের উপায় নেই।” কয়েক দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, হাসপাতালগুলিতে যেমন ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান খোলা হচ্ছে, জেলায়-জেলায় তেমনই সরকারি আলুবীজের দোকান খোলা হবে। প্রদীপবাবু জানান, আজ, মঙ্গলবার থেকে রাজ্যের ছয় জেলায় সরকারি ভাবে আলুবীজ বিলি শুরু হবে। তবে তা যে পরিমাণের তুলনায় সামান্য তা-ও কেউ অস্বীকার করতে পারছেন না।
এই রাজ্যে বেশি আলু চাষ হয় বর্ধমান, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, বাঁকুড়া, কোচবিহারে। প্রায় সর্বত্রই চাষিরা মূলত পঞ্জাবের জলন্ধরের বীজের উপরই নির্ভরশীল। প্রতি মরসুমে ৪৫ থেকে ৫০ লক্ষ বস্তা (৫০ কেজি) পঞ্জাবের আলুবীজ রাজ্যে আসে। বর্ধমানের খণ্ডঘোষের আলুচাষি সুকুমার ঘোষ বলেন, “গত বার যে বস্তা ১০০০-১২০০ টাকায় কিনেছিলাম, তা-ই দু’হাজার টাকা চাইছে। অন্য রাজ্যে যাওয়ার পথে আলুর গাড়ি সরকার আটকে দিল আর এই বেলায় সরকার উদাসীন কেন?”
কোচবিহারে দিনহাটার আনোয়ার হোসেন গত বার ১০ বিঘে জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। তাঁর আক্ষেপ, “ডিসেম্বরের গোড়ায় বীজের সমস্যা না মিটলে অন্য কোনও সব্জি চাষ করব ভাবছি।” চন্দ্রকোনা রোডের আলুচাষি সুফল পান বলেন, “সরকার ব্যবস্থা না নিলে এ বার আলু চাষ করব না।” তাঁর জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে অন্যান্য বছর যেখানে এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু বোনা হয়ে যায়, এখনও পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ১২ হাজার হেক্টরে।
চন্দ্রকোনা রোড থেকে শুধু গোটা পশ্চিম মেদিনীপুর নয়, অন্য জেলার চাষি এবং ব্যবসায়ীরাও বীজ আলু নিয়ে যান। সেখানে এখনও পর্যন্ত ৩০০ গাড়ি বীজ আলুর জোগান কম রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, এই রাজ্যের বীজ আলু কেনেন বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশের মতো কিছু রাজ্যের ব্যবসায়ী ও চাষিরা। কিন্তু ভিন্ রাজ্যে আলু পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় তাঁরা পঞ্জাবে ভিড় করেছেন। ফলে দর বেড়ে গিয়েছে।
রাজ্যের সর্বত্রই আলুবীজের মান নিয়ে ভুরি-ভুরি অভিযোগ রয়েছে। বীজের উপরে ফলনের পরিমাণ ও মান নির্ভর করে। চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বীজের মান অনেক ক্ষেত্রেই ভাল হচ্ছে না। বীজ খারাপ হওয়ায় বহু সময়েই চাষে বিপর্যয় হচ্ছে। অথচ পঞ্জাবের ব্যবসায়ীদের কাছে মান নিয়ে অভিযোগ করলেও তাঁরা দায় গুরুত্ব দিচ্ছেন না। সরকারি নজরদারি না থাকায় জালিয়াতিও চলছে। ব্যাঙের ছাতার মতো যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা কারবারিরা পঞ্জাবের স্ট্যাম্প লাগিয়ে নিম্নমানের বীজ চড়া দামে বিক্রি করছে। তিনশোটিরও বেশি আলুবীজ বিক্রির সংস্থা রয়েছে রাজ্যে। কিন্তু তারা যথাযথ মান বজায় রাখছে কি না তা দেখার মতো কোনও পরিকাঠামো নেই। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা অবশ্য বলেন, “আলুবীজের মান খারাপ হওয়ার অভিযোগ পেলে সরকার কড়া ব্যবস্থা নেবে।” খুব তাড়াতাড়ি রাজ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে ভাল বীজ উৎপাদনের তোড়জোড় চলছে বলেও তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। |