বাজারের উত্তাপে এ বার তপ্ত হতে চলেছে বিধানসভা!
আলু-সহ সব্জি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে সরকারকে নিশানা করতে চলেছে বিরোধী বাম ও কংগ্রেস। বিরোধীরা কোমর বাঁধছে বুঝে দ্রুত ময়দানে নেমে পড়েছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিরোধীদের আক্রমণের ঢাল প্রস্তুত রাখতে দলীয় বিধায়কদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এবং এ ব্যাপারে কোনও গুজব বা বিতর্কে আমল না-দিয়ে এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
শোকপ্রস্তাব হয়ে সোমবার মুলতবি হয়ে গিয়েছে শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিন। মুলতবির পরে এ দিন বিধানসভায় তৃণমূল পরিষদীয় দলের বৈঠকে মমতা তাঁর বিধায়কদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, সরকারকে বিভ্রান্ত করতে এক দল স্বার্থান্বেষী আলু-নুনের সঙ্কটের গুজব ছড়াচ্ছে। গুজব বন্ধে বিধায়কদের সতর্ক থাকতে বলেছেন তিনি। এই মূল্যবৃদ্ধিকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা আক্রমণ করবে বুঝে আগেভাগেই মূল্যবৃদ্ধির দায় কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে চাপিয়েছেন মমতা। তৃণমূলের মহাসচিব ও পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী দলের বৈঠকে বিধায়কদের জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের ভ্রান্ত নীতির ফলেই এই মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে রাজ্য সরকার মানুষকে পাশে নিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। বিধায়কদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছেন।”
বিরোধীদের আবার পাল্টা অভিযোগ, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের উপরে দোষ চাপিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে এ দিনই ধর্মতলা থেকে এন্টালি বাজার পর্যন্ত মিছিলের পরে বামফ্রন্টের এক প্রতিবাদ সভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “মূল্যবৃদ্ধির জন্য রাজ্য সরকারকেই সব কৈফিয়ত দিতে হবে, তা নয়। এর জন্য কেন্দ্রের ভুল নীতিও দায়ী। কিন্তু দিল্লিতে বিজেপি এবং কংগ্রেস, দুই সরকারের সময়েই যখন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে, তখন মন্ত্রিসভায় তৃণমূল ছিল!”
তাঁর আরও অভিযোগ, “তৃণমূলের লোকেরা যে ভাবে আলু থেকে সব্জি, সব ব্যাপারে তোলা তুলছে, তাতে জিনিসের দাম আরও বাড়ছে!” বাম আমলে দাম বাড়লে বিরোধী নেত্রী মমতা যে স্লোগান দিতেন ‘দাম বাড়লে খাব কী? বামফ্রন্ট যাবে কি?’, সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন সূর্যবাবু। অন্য দিকে, কংগ্রেস পরিষদীয় দলের বৈঠকের পরে দলের বিধায়ক মানস ভুঁইয়া প্রশ্ন তুলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী আলুর দাম ১৩ টাকা বেঁধে দেওয়ার পরেও কেন ২০-২২ টাকা দাম? এ ভাবে সব্জির দাম বৃদ্ধিতে রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? এর জন্যও কি কেন্দ্র দায়ী? নিজেদের দোষটা স্বীকার করুন!”
বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু-সহ সব শরিক নেতৃত্বের উপস্থিতিতে এ দিন আলিমুদ্দিনে বাম বিধায়কদের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা, নারী নির্যাতন, গণতন্ত্রের উপরে আক্রমণ-সহ বিভিন্ন প্রশ্নে পরিষদীয় যাবতীয় কৌশল কাজে লাগিয়ে আক্রমণে যাওয়া হবে। পরে সন্ধ্যায় এন্টালির সভায় বিমানবাবু বলেন, “মূলবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিধানসভার মধ্যে ও বাইরে আমাদের আন্দোলন করতে হবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর লড়াই একই সঙ্গে চালাতে হবে।” সভায় বক্তা ছিলেন সিপিআইয়ের প্রবীর দেব, আরএসপি-র মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লকের হাফিজ আলম সৈরানি প্রমুখ। বামফ্রন্টের তরফে পোস্টার তৈরি করে দেখানো হয়েছে, ২০১১-র মে মাস থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ও সব্জির দাম কী ভাবে গড়ে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে!
তৃণমূল নেত্রী তাঁর বিধায়কদের নির্দেশ দিয়েছেন, এলাকায় গিয়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে। যার প্রেক্ষিতে সূর্যবাবু পাল্টা বলেছেন, “এত দিন ওঁর খেয়াল ছিল না! যখন উচ্ছে, পটল, ঝিঙে সব ৫০ টাকার উপরে দাম চড়ে গিয়েছে, তখন উনি আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে দলের বিধায়কদের পথে নামতে বলছেন!” বাম এবং কংগ্রেসের মতোই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বিধানসভায় আলোচনার জন্য এ দিন সর্বদল ও কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন এসইউসি বিধায়ক তরুণ নস্কর। সব দলই যখন বিরোধিতা করছে, তখন মেট্রোর ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদেও বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করে রেলের কাছে পাঠানোর কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোনও সাড়া তিনি পাননি।
কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব জানিয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশিই সারদা-কাণ্ডে দোষীদের শাস্তির দাবি তুলে বিধানসভায় সিবিআই তদন্তের দাবি তাঁরা তুলবেন। প্রথম থেকেই মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভাকে এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে বিরোধীরা বারবার অভিযোগ করেছে। এ বারও যে ক’দিন অধিবেশন হওয়ার কথা, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে সংশয়ে রয়েছে শাসক দলই। মুখ্যমন্ত্রী যাতে বিধানসভায় উপস্থিত হয়ে তাঁর অধীনে থাকা দফতরগুলির প্রশ্নের জবাব দেন, কংগ্রেসের তরফে তার আবেদন জানিয়েছেন মানসবাবু। |