এত দিন কথাগুলো বলছিলেন প্রশাসনিক বৈঠকে। বারবার সতর্ক করছিলেন, কাজ ফেলে রাখা চলবে না। এ বার প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের সামনেই প্রশাসনের উপরে চাপ বাড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী। স্পষ্ট বলে দিলেন, কাজ ভাল না বাসলে কাজ করা উচিত নয়। কাজ ফেলে রাখা, দায়সারা ভাবে কাজ করা চলবে না।
সোমবার ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের একটি অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, সরকারি কাজকর্মে দীর্ঘসূত্রিতার বদভ্যাস বদলাতে তিনি বদ্ধপরিকর। এবং তার জন্য শুধু প্রশাসনিক আধিকারিকদের দোষ দেওয়া নয়, শুধু মন্ত্রীদের বার্তা দেওয়া নয়, শুধু কয়েকটি দফতরকে বেঁধা নয় সামগ্রিক ভাবে প্রশাসনের কর্মসংস্কৃতি নিয়েই এ দিন সরব হয়েছেন মমতা। চাপ বাড়াতে চেয়েছেন সরকারের প্রতিটি স্তরের কর্মীদের উপরেই। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য পরিকল্পনাহীন সিদ্ধান্ত, বিবেচনা ছাড়া কাজ করা এবং মানুষকে অপেক্ষা করিয়ে রাখার অভ্যাস ছাড়তে হবে।
মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “খাটতে হবে। চোখকান খোলা রেখে কাজ করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে ফাইল পড়ে থাকলে চলবে না। কাজ কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কাজ ভাল না-বাসলে কাজ করা উচিত নয়।” মমতার কথায়, বিভিন্ন নিগমের চেয়ারম্যান হয়ে লালবাতি লাগানো গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো কিংবা দফতরের মন্ত্রী হিসেবে শুধু কয়েকটি ফাইল সই করলেই দায়িত্ব পালন করা হয় না। কাজ করতে হলে কাজের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত হতে হয়।
ওতপ্রোত যুক্ত হওয়া বলতে কী বোঝাচ্ছেন মমতা? মুখ্যমন্ত্রী প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতরের কাজ থেকেই উদাহরণ দিয়ে বলেন, গ্রামের মা-বোনেরা, যাঁরা মুরগি-গরু-ছাগল-শুয়োর প্রতিপালনের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ তৈরি করেন, তাঁদের স্বাস্থ্যবিমা বা মেডিক্লেম করানোর দায়িত্ব দফতরকেই নিতে হবে। দফতরের মন্ত্রী ও অফিসারদের উদ্দেশে মমতা বলেন, “এত দিন এটা কেন ভাবেননি, জানি না।” |
না ভেবে কাজ করার আরও দৃষ্টান্ত মমতা দিয়েছেন। যেমন, এ বছর ২১ হাজার টনেরও বেশি গোখাদ্য বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে প্রাণিসম্পদ দফতর। মমতা বলেন, “গোখাদ্য যাঁদের দেবেন, তাঁদের একটা করে গরুও দেবেন। গরু থাকলে তবে তো গোখাদ্য লাগবে। এগুলো আমাকে বলতে হবে কেন?”
মমতার কথায় এ দিন স্পষ্ট ছিল, তাঁর ক্ষোভ শুধু গ্রামের মেয়েদের মেডিক্লেম বা গোখাদ্য নিয়ে নয়। এই উদাহরণগুলো সামনে রেখে তিনি বার্তা দিতে চাইছেন গোটা প্রশাসনকেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যত কাজ করতে চাইছেন, বাস্তবে তা না হওয়ার পিছনে প্রশাসনিক গড়িমসিই যে অন্যতম কারণ, সেটা মমতা এ দিন ঠারেঠোরে বলেই দিয়েছেন। তাঁর কটাক্ষ, “সকালে উঠে বাজারে নুন আর আলুর জোগান ঠিক আছে কি না, সেটা দেখা আমার কাজ নাকি? তবু আমাকে সেটা করতে হয়। আমাকে তো জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবই করতে হয়।”
মন্ত্রী, অফিসার ও সরকারি কর্মীদের একটা বড় অংশের মধ্যে কাজ ফেলে রাখার প্রবণতার দিকে আঙুল তুলে কর্মসংস্কৃতি পাল্টে ফেলার ডাক দিয়েছিলেন মমতার পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘ডু ইট নাউ’। কিন্তু ঐতিহ্য বদলায়নি। ক্ষমতায় আসার পর থেকে মমতাও সরকারি অফিসের ঢিলেঢালা মনোভাব বদলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আড়াই বছর পরেও কর্মসংস্কৃতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন যে তেমন হয়নি, সেই অভিযোগ বারবার উঠছে। এমনকী, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ মানুষেরাও অভিযোগ করেন, তাঁদের আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীর পেনশনের ফাইল এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে বছর ঘুরে যায়। এ দিন মমতা নিজে বলেন, “কিছু লোকের কাজ-ই হল, সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করানো। খালি বলেন, আজ নেই, কাল আসুন।’’
তবে এই অবস্থাটা পাল্টানোর লক্ষ্যেই মমতা জন পরিষেবা অধিকার আইন চালু করেছেন। যে আইনের মূল কথা হল: আমজনতার দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন পরিষেবা প্রদানের নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ও অফিসারদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া। আইনে বলে দেওয়া আছে, ট্রেড লাইসেন্স কিংবা বিল্ডিং প্ল্যান, জন্মমৃত্যুর শংসাপত্র অথবা বাড়ির জলের সংযোগ নিয়ে আবেদন করার কত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দফতর তা দিতে বাধ্য থাকবে।
প্রশাসনের দাবি, এই আইন তৃণমূল স্তরে দুর্নীতিমুক্ত পরিষেবা প্রদানে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীও এ দিন ফের জানিয়ে দিয়েছেন, দু’দিনের মধ্যে বার্থ সার্টিফিকেট দিতে না পারলে জরিমানা করা হবে। সরকারি দফতরে ফাইল পড়ে থাকার সংস্কৃতি তিনি বরদাস্ত করবেন না। ফাইল ট্র্যাকিং সিস্টেম-এ তিন দিনের মধ্যে কোনও সরকারি ফাইল কোথায়, কী অবস্থায় আছে, তা জানা যাবে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, “কাজ না করে, শৃঙ্খলা না মেনে কোনও সংস্থা ক্রমশ শুকিয়ে রুগ্ণ হয়ে যাবে, সেটা হবে না। এক দল লোকই আছে, তারা নিজেরাও কাজ করবে না। অন্যকেও করতে দেবে না। কিন্তু আমি বলে দিচ্ছি, নতুন করে কোনও জঞ্জাল আমি চাই না।” বামফ্রন্ট আমলে হরিণঘাটা সংস্থা ক্রমশ রুগ্ণ হয়েছিল। হরিণঘাটার বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫০টি কিয়স্কের সংস্কার করে সেগুলিতে নতুন সরকারি বিপণন কেন্দ্র করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিন তার উদ্বোধন করেন।
এ দিনের অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতর। দফতরের অধীন একটি নিগমের চেয়ারম্যান সম্প্রতি পারিবারিক কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে মাত্রাতিরিক্ত অঙ্কের ‘বিল’ জমা দেওয়ার বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। সম্ভবত, সে জন্যই মমতা বলেন, “কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হয়ে লালবাতি লাগানো গাড়ি চড়লে বা কোনও দফতরের দায়িত্ব নিয়ে কয়েকটা ফাইল সই করলে হবে না। কাজ করার সময়ে চোখকান খোলা রাখুন।’’
মুখ্যমন্ত্রী যখন এই সব কথা বলছেন, সেই সময়ে মঞ্চে বসে দফতরের মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী এবং দফতরের বিভিন্ন নিগমের চেয়ারম্যানেরা। কথা বলার সময়ে কর্ডলেস মাইক হাতে মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের দিকেই তাকিয়েছিলেন। এ দিন প্রায় ১৮ মিনিটের বক্তৃতায় অনেক সময়েই মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে উপবিষ্ট মন্ত্রী- আধিকারিকদের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছেন। মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরীর কাজে মুখ্যমন্ত্রী ইদানীং সন্তুষ্ট নন বলেই প্রশাসনিক সূত্রের খবর। মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের কড়া বার্তা তাই স্বভাবতই দফতরকে বিড়ম্বনায় ফেলেছে।
এ ছাড়া আর কোন কোন দফতরের মন্ত্রী এবং কোন কোন নিগমের চেয়ারম্যান মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণের লক্ষ্য হলেন, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর কথার সমর্থন মিলেছে একাধিক মন্ত্রীর কথাতেও। রাজ্যের সেচমন্ত্রী ও পশ্চিমবঙ্গ কৃষিভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। পরিকল্পনা করে এগোলে ফল যে পাওয়া যায়, তার উদাহরণ আমার নিগম।” ওই নিগম সিপিএমের আমলে লোকসানে চলত। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে তারাই এ বছর দশ কোটি টাকা লাভ করেছে বলে জানান রাজীব। শিল্পমন্ত্রী এবং শিল্পোন্নয়ন নিগম ও শিল্প পরিকাঠানো উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও বলছেন, “নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে স্বচ্ছতা, সততা বজায় রেখে দ্রুত কাজ করতে হবে। গড়িমসি চলবে না।” কাজের জায়গায় আপসকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সে কথা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগম এবং রাজ্য অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকার। তাঁরও বক্তব্য, “পরিকল্পনাহীন কাজ করে কোনও লাভ নেই। ঠিকঠাক কাজ করতে না পারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াই উচিত।”
তবে অভিরূপবাবু এ-ও বলেন, “আমাদের এখানে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক বাধাও আছে। সেগুলো এক দিনে অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এটা নিয়ে ভাবতে হবে।”
প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন দফতর নিজে কী বলছে? মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরী বলেন, “আমাদের কয়েকটি নিগমে কিছু পদ ফাঁকা রয়েছে। সে জন্য কিছু অসুবিধা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী উৎসাহ দিতেই ওই কথা বলেছেন।” |