|
|
|
|
অবহেলায় হতশ্রী ‘লাল বিল্ডিং’ |
অমিত কর মহাপাত্র • এগরা |
খালের ধারে একটা ভগ্নপ্রায় দোতলা বাড়ি। দেখে বোঝা যায় এক সময় অনেক যত্ন করে বানানো হয়েছিল। উনবিংশ শতকে নবজাগরণের পটভূমিকায় মেদিনীপুরে ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষার প্রসার যে এই ভবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, তা অবশ্য জানা নেই অনেকের। অবহেলায়, বঞ্চনায় মহিষাদল শহরে হিজলি টাইভাল ক্যানালের পাড়ে ঐতিহাসিক ‘লাল বিল্ডিং’ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে। ন্যূনতম রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারটুকুও করেনি কেউ। ‘হেরিটেজ’ মর্যাদা দিয়ে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার দাবি অবশ্য দীর্ঘ দিন ধরেই জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। আশ্বাস মিললেও কাজ হয়নি।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক সংকর্ষণ মাইতি জানান, মহিষাদল রাজবংশের রাজা লক্ষ্মণপ্রসাদ গর্গের আমলেই শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার বিস্তার ঘটে সবচেয়ে বেশি। তিনি নিজে ইংরেজি-সহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। রাজবাড়ির দুর্গামন্দিরে ১৮৭০ সাল থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। প্রায় সেই সময়ই লক্ষ্মণপ্রসাদ তাঁর ছেলে ঈশ্বরপ্রসাদকে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে এক ইংরেজ গভর্নেস নিযুক্ত করেন। ওই ইংরেজ গভর্নেসের পরিবার থাকার জন্য ক্য্যনালের পূর্ব পাড়ে মনোরম পরিবেশে ফরাসি রীতির একতলা একটি বাংলো নির্মাণ করা হয়। ১৭৭৪ সালে ওই বাংলোতেই প্রতিষ্ঠা হয় ‘মহিষাদল রাজ ইংলিশ হাইস্কুল’। ১৮৮৪ সালে ঈশ্বরপ্রসাদ রাজা হওয়ার পর লালরঙের ওই বাংলোটিকে দোতলায় রূপান্তরিত করে সাধারণ মানুষের শিক্ষার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। পরে ওই ভবন ‘মহিষাদল রাজ হাইস্কুল’ নামে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৮৬ সাল নাগাদ পড়ুয়াসংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় পাশেই রাজ হাইস্কুলের জন্য আলাদা ভবন তৈরি হয়। এই সময় থেকেই পুরনো ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এখন ওই ভবনের দরজা-জানালা ভাঙা, ছাদের চাঙড়ও খসে পড়েছে, দেওয়ালে আগাছা ও শ্যাওলার বাসা। সব মিলিয়ে যেন একটা ভূতুড়ে পরিবেশ ‘লাল বিল্ডিং’কে ঘিরে। |
|
সংস্কারের আশ্বাসই সার। —নিজস্ব চিত্র। |
অথচ, এক দিন এই লাল বিল্ডিং বিশিষ্ট সব লোকজনের ভিড়ে গমগম করত। এই ভবনেই পড়েছেন হিন্দি সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা, তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত-সহ বহু কৃতী। শিক্ষকতা করেছেন কবি জলধর সেনও। তাই ১৩১ বছরের প্রাচীন ওই ভবনকে সংস্কার করে এলাকার শিক্ষার ইতিহাসকে ধরে রাখার পাশাপাশি বরেণ্য ওই মানুষদের স্মৃতিতে একটি সংগ্রহশালা গড়ার দাবি তুলেছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ।
লাল বিল্ডিংকে ঘিরে প্রথম হেরিটেজ করার দাবি ওঠে স্কুলের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে। ২০১২ সালে রাজ হাইস্কুলের সামনে সূর্যকান্তের আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন রাজ্যপাল বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী। তাঁর কাছেও একই দাবি রাখা হয়। এলাকাবাসীর অভিযোগ, বিধায়ক-সাংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরে বারবার এই আবেদন জানানো হলেও আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়নি। রাজপরিবারের প্রধান সদস্য হরপ্রসাদ গর্গ এ ব্যাপারে ক্ষোভ লুকিয়ে না-রেখেই বলেন, “হেরিটেজ কমিশন ও সরকারি বিভিন্ন দফতরে ওই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার উদাসীন। সংস্কারের জন্য এখনই উদ্যোগী না হলে ঐতিহ্যশালী ওই ভবন যে কোনও দিন ভেঙে পড়বে।”
রাজবাড়ির সদস্য শৌর্যপ্রসাদ গর্গ বলেন, “ভবনটি সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমরা ২০০৮ সাল থেকে লাগাতার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিভাগীয় মন্ত্রীর কাছেও আবেদন জানাব। আমরা চাই এখানে শিশুদের আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা হোক। কারণ, ভবনটির ইতিহাস শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত।”
ভবনটির মালিকানা মহিষাদল রাজ হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের। ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনও আগ্রহ নেই বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র তথা পরিচালন সমিতির সম্পাদক বুদ্ধদেব ভৌমিক অবশ্য বলেন, “ওই ভবন সংস্কার করতে গেলে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা স্কুলের নেই। তাই সাংসদ, হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদ, সর্বশিক্ষা মিশনে আবেদন জানানো হয়েছে। এলাকার অনেক বাসিন্দাই ওই ভবন রক্ষা করতে আর্থিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছেন। তা ছাড়া, ভবনটিকে হেরিটেজ স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি ও হেরিটেজ কমিশনকে আবেদন করা হয়েছে।” ভবনটি নিজে দেখে এসেছেন বলে জানিয়েছেন জেলাশাসক অন্তরা আচার্য। তিনি বলেন, “ওই ভবন নিয়ে জেলার হেরিটেজ কমিটির কাছ থেকে সার্বিক তথ্য চেয়েছি। তা পেলে হেরিটেজ কমিশনের কাছে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানাব।”
আশ্বাসের ভিত শক্ত হয়ে ঐতিহাসিক ভবনের পতন ঠেকাতে পারে কি না সেটাই দেখার। |
|
|
|
|
|