|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
সরকারি হাসপাতাল: এখনই যা করা যায়
ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিকাঠামো, সবই প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এই
সুযোগেই সরকারি হাসপাতালে জমে ওঠে ঘুষের কারবার। ঘাটতি দূর করা
সময়সাপেক্ষ। কিন্তু দুর্নীতি কমানোর অন্য নানা উপায় আছে।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল |
বিদেশ বিভুঁইয়ে বসে সোমা মুখোপাধ্যায়ের প্রতিবেদন (‘টাকা ফেলুন, হাসপাতালে তবেই মিলবে রোগীর ট্রলি’, ১১-১১) পড়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে সন্তান প্রসবের আগেই মা সন্তানহারা হন, কিংবা অসুস্থ আত্মীয়কে হাসপাতালের ঠিক ঠিক বিভাগে পৌঁছে দিতে গিয়ে কেউ নিজেই আহত হয়ে পড়েন এ ধরনের ঘটনা আমাদের সরকারি হাসপাতালে বিরল নয়। প্রয়োজনের সময় যে পরিষেবা আমাদের প্রাপ্য, তা আমরা পাই না। বলা হয়, টাকার অভাব, পরিকাঠামোর অভাব। সত্যিই পরিকাঠামো পর্যাপ্ত মানের নয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, যেটুকু আছে, সেটুকুর সদ্ব্যবহার হয় কি?
জোগান কম থাকলে অতিরিক্ত চাহিদা থাকবেই। সেটা ঠিক ভাবে ব্যবহার করার জন্য যেটা সর্বাপেক্ষা জরুরি, তা হল একটি সংবেদনশীল, নিয়মনিষ্ঠ ব্যবস্থাপনা। বিশেষত স্বাস্থ্য পরিষেবার মতো একটি ব্যাপারে, যেখানে ঠিক সময়ে ঠিক পরিষেবা না পেলে পরিষেবা থাকা আর না-থাকার মধ্যে তেমন ফারাক নেই। জোগানের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। এই রাস্তাটি ধরেই যেটা জনস্বাস্থ্য পরিষেবা সরবরাহের মধ্যে প্রবেশ করে, সেটা হল দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ২০১১ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতে প্রতি বছর ২০০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ স্বাস্থ্য-দুর্নীতির জন্য নষ্ট হয়। সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাও এর সঙ্গে সমঞ্জস। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা সরকারি হাসপাতালে যান, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ মনে করেন, প্রয়োজনীয় পরিষেবা পেতে হলে কোনও না কোনও ভাবে, কাউকে না কাউকে ঘুষ দিতেই হবে। অর্থাৎ, এ সব আমরা মেনেই নিয়েছি।
চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি থাকলে ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়, এটা সত্যি। কিন্তু প্রশাসনিক গাফিলতির ফলে তা বাস্তবায়িত হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক গাফিলতি চাহিদা-জোগানের ফারাক বাড়িয়ে দেয়। যা ঘুষ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে। পশ্চিমবঙ্গে দু’বছর আগে সরকারি হাসপাতালগুলির দক্ষতা নিয়ে এক সমীক্ষা চালানো হয়। কিছু বিশেষ ধরনের হাসপাতাল পর্যবেক্ষণ করে সমীক্ষকরা বলেছেন, বহির্বিভাগে ডাক্তারদের যতক্ষণ থাকার কথা, তাঁরা গড়পড়তা তার অর্ধেকের বেশি সময় অনুপস্থিত থাকেন। এবং হাসপাতাল যত বড়, বরাদ্দ ডাক্তারের সংখ্যা যত বেশি, অনুপস্থিতির হারও তত বেশি। |
পরিষেবা। সরকারি হাসপাতাল, মেদিনীপুর। এপ্রিল ২০১৩। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ। |
এর ফলে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের জোগান কার্যক্ষেত্রে আরও কমে যায়। ফলত হাসপাতালগুলিতে রোগীর চাপ আরও বাড়তে থাকে। প্রত্যেক রোগীর জন্য ডাক্তারবাবুর বরাদ্দ সময় কমে যায়, সুচিকিৎসা পাওয়ার সম্ভাবনা কমে। এতে ডাক্তারবাবুর কোনও দোষ থাকে না। তিনি তো জানেন, বাইরে প্রচুর অসুস্থ মানুষ অপেক্ষা করছে। কোনও এক দিনের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডাক্তারের পক্ষে সবাইকে পরিষেবা দেওয়াও সম্ভব হয়ে ওঠে না। সাধারণ মানুষ, যাঁরা দূরদূরান্তর থেকে নিজেদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম ফেলে হাসপাতালে যান, তাঁদের পক্ষে আবার দ্বিতীয় দিন যাওয়াটা খুব কষ্টকর, সামর্থ্যেও কুলোয় না। সেই সুযোগে হাজির হয় একদল মধ্যস্থ, যারা কিছু অর্থের বিনিময়ে ডাক্তার দেখানোর বন্দোবস্ত করে দেয়। এতে আমরাও খুশি হই। কারণ, পরিষেবাও পেলাম, আবার দ্বিতীয় দিন আসতেও হল না। ও দিকে ডাক্তারবাবু টেরটিও পেলেন না কোথা দিয়ে ঘুষ দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেল। এ রকম আকছার হয়। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ডাক্তার দেখাতে হলে নাকি রিকশাওয়ালাকে টাকা দিয়ে নাম লিখিয়ে রাখতে বা টিকিট করাতে হবে। রিকশাওয়ালা তো আর ডাক্তার দেখানোর বন্দোবস্ত করে না, করে হাসপাতালের সঙ্গে কোনও ভাবে সম্পর্কিত কেউ। মানে, একটা আঁতাঁত থাকে, যারা এই দুর্নীতি চক্রটা চালায়। এ রকম চক্র সারা হাসপাতালের বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ করে বেড়ায়। হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ, সরঞ্জাম কেনা, রোগী ভর্তি এবং বেড পাওয়া, বিভিন্ন ডাক্তারি পরীক্ষানিরীক্ষা করানো সবেতেই অল্পস্বল্প ঘুষ দেওয়ার রীতি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তবে বলে রাখা ভাল যে, বেশির ভাগ স্বাস্থ্যকর্মী, ডাক্তারই কিন্তু নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং দায়িত্বশীল। এঁদের জন্যই পরিষেবা এখনও থমকে যায়নি। অল্প কিছু সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তার আছেন, যাঁদের জন্য সংকট ঘনীভূত হয়।
এ সমস্যা সারা বিশ্বে। বিশেষত স্বল্প-আয়ের দেশগুলিতে স্বাস্থ্যে দুর্নীতির প্রকোপ ভয়াবহ। ইউ এন ডি পি, ডব্লিউ এইচ ও, ডি এফ আই ডি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি সংস্থা সারা বছর ধরে বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের গবেষণা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য-দুর্নীতি নিয়ে। তার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য-দুর্নীতি রোধ করার জন্য যে-সব সমাধানের রাস্তা দেখানো হয়েছে, ভেনেজুয়েলা, কেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, হংকং প্রভৃতি দেশে এর মধ্যেই তার কিছু সুফলও পাওয়া গেছে। সেগুলি আমাদের সমস্যার ক্ষেত্রেও ভীষণ ভাবে প্রযোজ্য। এ বার দেখা যাক, কোন কোন রাস্তায় সমস্যা হ্রাস করানো সম্ভবপর।
১) কোন হাসপাতালে কত যন্ত্রপাতি আছে, কী পরিষেবা পাওয়া যায়, কোন বিভাগে কত ডাক্তার আছেন, কত স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, কে কখন কোন বিভাগের দায়িত্বে থাকবেন, সে সব তথ্য সংবলিত বৈদ্যুতিন বোর্ড এমন জায়গায় ঝোলানো থাকবে, যাতে তা সহজেই সবার নজরে পড়ে। হাসপাতালের বিশদ ম্যাপ বিভিন্ন স্থানে লাগাতে হবে যেন রোগীর বুঝতে অসুবিধা না হয়, কখন কোথায় কী পাওয়া যাবে। তথ্যের স্বচ্ছতা যত বাড়বে, তত কমবে দুর্নীতির প্রবণতা। এ ধরনের বোর্ড এখন কিছু কিছু আছে, কিন্তু সেগুলি হয়তো তিন বছর আগে হাতে লেখা, নিয়মিত পরিবর্তন করা হয় না।
২) কোথাও কেউ কোনও সমস্যায় পড়লে কার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, তাঁর নাম, ফোন নম্বর এবং কার্যালয়ের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য সবাইকে জানাতে হবে। এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে, এ ধরনের কার্যালয় প্রতিটি হাসপাতালে একটি করে থাকবে এবং সেখানে দিবা-রাত্রি কেউ-না-কেউ দায়িত্বে থাকবেন। এ ধরনের নিশ্চয়তা রোগীর বাড়ির লোককে ভরসা জোগাবে এবং ঘুষ না দেওয়ার অনুকূল মনোভাব তৈরি করে।
৩) ডাক্তার দেখানোর জন্য, অপারেশনের ক্ষেত্রে কিংবা যে-কোনও পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ রোগীর তালিকা জনসমক্ষে রাখতে হবে। বিভিন্ন বিভাগের জন্য বিভিন্ন তালিকা থাকতে পারে। এটা বৈদ্যুতিন বড় আকারের হওয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে সবাই দূর থেকেই দেখতে পায়।
৪) ওষুধপত্রের দাম সংক্রান্ত তথ্য-তালিকা নির্দিষ্ট স্থানে যথাযথ ভাবে থাকা প্রয়োজন। কারণ, অসুস্থতার সময়ে আমরা অনেকেই নজর করি না, কোন ওষুধের কত টাকা দাম নেওয়া হয়। এটাও সম্ভাব্য দুর্নীতির কারণ।
৫) স্বাস্থ্যকর্মী ও ডাক্তারবাবুদের উপস্থিতি নিয়মিত করার জন্য প্রয়োজনে উৎসাহ ভাতা এবং জনসমক্ষে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত। ঠিক যেমনটা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হয় ছবি ও নাম-সহ বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া থাকে। সামাজিক স্বীকৃতির ‘লোভ’ও যদি কাজ না করে, তা হলে তার জন্য কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান রাখতে হবে। তবে তা কেমন হবে, সেটা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও প্রশাসন ঠিক করবে। এবং সেই সঙ্গে সাপ্তাহিক বা মাসিক হিসেবে অনুপস্থিতির তালিকাও সর্বসমক্ষে ঝুলিয়ে দিতে হবে।
৬) সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিকাঠামো উন্নয়ন, থাকার ব্যবস্থা, ঠিক মানের স্কুল, যথাযথ পরিবহণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে কোনও স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতাল এলাকায় বসবাস করতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঠিক লালনপালন ও শিক্ষার কথা ভেবে আতঙ্কিত না হয়ে পড়েন।
৭) প্রয়োজন মাফিক স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে তাঁর উপস্থিতির হিসাব রাখার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। এর পাশাপাশি অনেকে আবার চুক্তি-ভিত্তিক নিয়োগ এবং দক্ষতা ও দায়িত্ব বিচার করার পর পুনর্নিয়োগের কথা বলেন। ডি এফ আই ডি এ বিষয়ে ভীষণ গুরুত্ব দিলেও আমাদের মতো রাজ্যে বা দেশে সেটা কতটা সম্ভব, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
৮) প্রশাসনকে যতটা সম্ভব বিকেন্দ্রীকৃত করে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, পুরসভা, পঞ্চায়েত বা জেলা পরিষদের প্রতিনিধিরা যেন নিয়মিত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যবেক্ষণ এবং তদারকির সুযোগ পান। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরকেও প্রশাসনিক পরিকাঠামো এবং আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে মতামত দেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে।
৯) পরিকাঠামো খাতে উন্নতির জন্য ব্যয়বরাদ্দ যতটা সম্ভব বাড়ানো প্রয়োজন। ফারাক যতটা কমবে, ততটাই কমবে দুর্নীতির সম্ভাবনা।
পরামর্শগুলির কোনওটাই স্বল্পমেয়াদি ভাবে বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং তার জন্য দরকার রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কার ও স্থিতিশীলতা। সেটা শুধু সরকারি প্রচেষ্টায় হবে না।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের সমস্যা শুধু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নয়; শিক্ষকতা, ওকালতি সহ আরও নানা পেশায় রয়েছে। তবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তীব্রতাটা সবচেয়ে বেশি এবং তার পরিণতি সবচেয়ে ভয়ংকর। |
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলবনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|