রাস্তার ঠিক মাঝখানে পড়ে রয়েছে বাড়ির চাল। আর তার উপর মুখ থুবড়ে পড়ে তালগোল পাকানো একটা গাড়ি। রবিবার সন্ধ্যার টর্নেডোর পর ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, আইওয়া, মিশিগান, ওহায়ো, মিসৌরি, উইসকনসিন জুড়ে ধ্বংসের চেনা ছবি এটাই। ঝড়ে প্রাণ গিয়েছে অন্তত ছ’জনের। আহত আরও শত শত। ঘরছাড়া লক্ষাধিক মানুষ।
মার্কিন আবহবিদরা কাল সকালেই সতর্ক করেছিলেন, ধেয়ে আসছে শক্তিশালী এক অকাল টর্নেডো। শেষমেশ অবশ্য একটা নয়, রবিবার সন্ধেবেলা হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে কম করে ৬০টা টর্নেডো। চোখের নিমেষে মাটিতে মিশে যায় সারি সারি বাড়ি।
“আমাদের গোটা পাড়াটা যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। যত দূর চোখ যায়, ভাঙাচোরা ঘর-বাড়ির ঢিপি ছাড়া আর কিছুই নেই। গোটা এলাকায় খালি একটাই দেওয়াল কী ভাবে যেন টিঁকে গিয়েছে! ওটা আমারই ফায়ারপ্লেসের দেওয়ালটা” ওয়াশিংটন থেকে ফোনে জানান মাইকেল পারডুন। |
সব থেকে শোচনীয় অবস্থা ইলিনয় প্রদেশের। যে ছ’জন মারা গিয়েছেন, সকলেই এই প্রদেশের বাসিন্দা। ঝড় আসা ইস্তক আঁধারে ডুবে গিয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। গাছ পড়ে বন্ধ রাস্তাঘাট। বহু এলাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছে না টেলিফোনেও। অ্যান্টনি খউরি জানালেন, “হাতির শুঁড়ের মতো ঝড়টা একেবারে আমার বাগানের পিছন দিকে এসে পড়েছিল। শুনতে পেলাম ওই দিক থেকে ভেসে আসছে কান্নার রোল।” শিকাগো থেকে ৮০ মাইল পশ্চিমে এক হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিল কিছু ট্রাক। এ রকমই ছ’টা মালবাহী ট্রাককে একে অন্যের ঘাড়ে এনে ফেলেছে দামাল হাওয়া।
শিকাগোর ‘সোলজার ফিল্ডে’ কাল বিকেলে এক ফুটবল ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। স্টেডিয়াম ভরে গিয়েছিল উৎসাহী দর্শকে। কিন্তু ঝড় আসছে খবর পেয়েই ফাঁকা করে দেওয়া হয় মাঠ। দর্শকদের মধ্যে ছিলেন জিম আর্নল্ড। জানিয়েছেন, “মুষলধারে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশের গায়ে কেউ যেন কালো রঙ ছিটিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে কান ফাটানো বাজের গর্জন। এগারো বছরের মেয়ের হাত শক্ত করে ধরেছিলাম। স্টেডিয়াম ফাঁকা করে আমাদের শেষ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় মাটির নীচের ঘরে।”
টর্নেডোর দাপট থামলে ইন্ডিয়ানার কোকোমোয় জরুরি অবস্থা জারি করেন সেখানকার মেয়র। সোমবার ভোর ছ’টায় শিথিল করা হয়েছে তা। তবে অকারণে কেউ যাতে বিধ্বস্ত এলাকায় না যান, কড়া নজর রাখা হচ্ছে সে দিকে। ঘরদোরের কঙ্কালের নীচে কেউ চাপা পড়ে আছেন কি না তা দেখতে রবিবার রাতেই রাস্তায় নামে উদ্ধারকারী দল।
আহতদের ভিড় উপচে পড়ছে স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে। পিওরিয়ার সেন্ট ফ্রান্সিস মেডিকাল সেন্টার সূত্রে খবর, কাল রাত থেকে ৩৭ জন ভর্তি হয়েছেন সেখানে। কেউ পাঁজরে চোট পেয়েছেন, কারও বা আবার আঘাত লেগেছে কোমরে। ঝড়ের দাপটে বাতিল করতে হয়েছে বহু বিমান। শিকাগোর ও’হেয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই শুধু বাতিল করা হয়েছে ২৭০টি উড়ান। দেরিতে উড়েছে আরও বেশ কিছু বিমান।
তবে অসময়ে কেন এ রকম টর্নেডোর কবলে পড়তে হল, তা নিয়ে সন্দিহান আবহবিদরা। এক সঙ্গে এতগুলো ঝড় কী ভাবে তৈরি হল, তা-ও রীতিমতো ভাবাচ্ছে তাঁদের। মার্কিন হাওয়া অফিসের ওয়েবসাইটে বলা হচ্ছে, ৬৫টি টর্নেডো তৈরি হয়েছিল কাল সন্ধেবেলা। কেউ কেউ আবার বলছেন আসল সংখ্যাটা ৭৭-এর কম হবে না। আবহবিদদের অবশ্য ধারণা, একটাই ঝড়কে একাধিক বার গোনা হয়েছে বলেই সংখ্যাটা এত বেশি ঠেকছে। তবে ষাটের কম হবে না কিছুতেই। ঝড় শিকারি টনি লাউবাচের নেশাই হল ঝড়ের পিছনে ছুটে বেড়ানো। “এত টর্নেডো তো দেখলাম, কিন্তু এটা যেন অন্য রকম। এত তাড়াতাড়ি সেগুলো সরে যাচ্ছে যে ঠাওর করাই মুশকিল।”
ফি বছরই কম বেশি টর্নেডোর কবলে পড়ে আমেরিকা। কিন্তু তা বেশি হয় বসন্তকালে। শীত শুরুর এই সময়টায় নয়। তা হলে এমন বিধ্বংসী ঝড় কেন? আবহবিদদের ব্যাখ্যা, অন্যান্য বছর এই সময় এতটা গরম থাকে না। এই বছর তাপমাত্রার পারদ যেন নামছেই না। শীত কালে গরম হাওয়াই যত নষ্টের গোড়া, মনে করছেন তাঁরা। |