সাত সকালেই গ্রামের আটচালায় আসতে শুরু করল একের পর এক চেয়ার-টেবিল। তারপরেই সাদা গাড়িতে এসে পৌঁছলেন প্রশাসনের আধিকারিকেরা। জেলায় জেলায় মহাকরণকে আগেই এনেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, এ বার গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েতকে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ করল জেলা পরিষদও।
সোমবার কালনা ২ ব্লকের বড়ধামাস পঞ্চায়েতের বালিন্দর গ্রাম থেকেই শুরু হল ‘আপনার পঞ্চায়েত আপনার গ্রামে’ নামে এই কর্মসূচী। বর্ধমান জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদের আধিকারিকেরা গ্রামবাসীদের সমস্যা শুনবেন। তার মধ্যে যেগুলি তখনই মেটানো সম্ভব তা মিটিয়েও ফেলা হবে। এছাড়া উন্নয়ন নিয়ে গ্রামবাসীদের মতামতও জানতে চাওয়া হবে। জেলা পরিষদের দাবি, রাজ্যে এমন উদ্যোগ এই প্রথম। |
এ দিন ১০টার মধ্যে গ্রামে পৌঁছে যান বড়ধামাস পঞ্চায়েতের প্রধান, উপ-প্রধান, নির্মাণ সহায়ক-সহ অন্যান্য কর্মীরা। সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করতে করতেই এসে যান জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু, দু’জন অতিরিক্ত জেলাশাসক রুমেলা দে ও হৃষিকেশ মোদি, কালনার মহকুমাশাসক শশাঙ্ক শেঠি, কালনা ২ ব্লকের বিডিও গৌরাঙ্গ ঘোষ, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আলমগীর সাত্তার। ভিড় জমাতে শুরু করেন এলাকাবাসীরাও। এরপর দুপুর ১২টা থেকে গ্রামেই শুরু হয়ে যায় পঞ্চায়েতের কাজ।
শুরুতেই অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) হৃষিকেশ মোদি এলাকার মানুষের কাছে তাঁদের সমস্যার কথা জানতে চান। প্রথমে একটু আড়ষ্টতা থাকলেও পরে বাসিন্দারা খোলাখুলিই সমস্যা জানাতে থাকেন। এলাকার সুনীল মাণ্ডির অভিযোগ, প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও সরকারি কোনও সুযোগ সুবিধা পান না তিনি। প্রশ্ন শুনেই হৃষিকেশবাবু মহকুমাশাসককে সুনীলবাবুর প্রতিবন্ধী কার্ড করার ব্যবস্থা করতে বলেন। এসডিও বলেন, “২৬ নভেম্বর পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুর এলাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটি শিবির হবে। সেখানেই সমস্যা মেটানো হবে।” আরেক বাসিন্দা দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, বাড়ির কাছে নিকাশি নালা না থাকায় একটি বৃষ্টিতেই জল জমে যায়। বিডিও ও প্রধানকে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। দিলীপবাবুর অভিযোগ শুনে অভিযোগপত্রটি দেখতে চান অতিরিক্ত জেলাশাসক। তারপরেই বিডিও-র কাছে জানতে চান, বিষয়টি কী অবস্থায় আছে। বিডিও জানান, পঞ্চায়েত সম্পাদককে দিয়ে তদন্ত করানো হয়েছে। ময়নাগুড়ির সুজয় পাল আবার পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি জানান, পঞ্চায়েতের নলকূপগুলি বছরের বেশিরভাগ সময় খারাপ পড়ে থাকে। আটটি মৌজার মধ্যে জলকষ্ট চরমে ওঠে ময়নাগুড়িতে। অথচ প্রায় তিন হাজার পরিবারের বাস সেখানে। তাঁর দাবি, ময়নাগুড়িতে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কোনও প্রকল্প হলে ভাল হয়। এডিএম দ্রুত বিডিও-র কাছে এলাকার বাসিন্দাদের স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি জমা দিতে হলেন। বিরাহা গ্রামের আব্দুল আলিম বলেন, অল্প বৃষ্টি হলেই গাঙ্গুর নদীর জল উপচে বিঘের পর বিঘে ধানজমি নষ্ট হয়ে যায়। পুরনো নদীপথটি সংস্কার হলে চাষিদের উপকার হয় বলেও তাঁর দাবি। এতে বড়ধামাস পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান মিতালী বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, এলাকার মানুষ লিখিত ভাবে কিছু জানাননি। এডিএম বলেন, “সবসময় লিখিত অভিযোগ জানাতেই হবে এমন নয়। সমস্যা দেখলে নিজেদেরও উদ্যোগী হতে হবে। শুধু একশো দিনের কাজে নয়, ব্লক প্রশাসনকে বলছি সেচ দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।” শুধু গাঙ্গুর নয়, বেহুলা নদীর নাব্যতা কমে যাওয়াতেও সমস্যা হচ্ছে বলে জানান চাষিরা। এছাড়া রাস্তা মেরামত, বিদ্যুৎ সেংযাগ, রেশনে অন্তোদয় যোজনার চাল না পাওয়া এই সব অভিযোগও উঠে আসে। প্রতিটি সমস্যা পঞ্চায়েতের কর্মীরা নথিভুক্ত করেন। সভায় গ্রাম উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত জেলাশাসক রুমেলা দেবী ১০০ দিনের কাজ ও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর নানা খুঁটিনাটি তুলে ধরেন। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর বৈঠক কবে হয়েছে বলতে না পারায় মৃদু ধমকও খেতে হয় পঞ্চায়েত সম্পাদক সিদ্ধার্থ মণ্ডলকে। রুমেলাদেবী জানান, জেলায় স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় মূল্য ৮ কোটি টাকা। সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গড়তে এগিয়ে আসতে বলেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন প্রশাসনিক দফতরে হয়রানির অভিযোগও করেন বাসিন্দারা। পোতানয়, টোলা, মুশিদপুর, দমদমা, বারডেলিয়া ইত্যাদি ১৩টি গ্রামের অভিযোগ শুনতে শুনতে বিকেল গড়িয়ে যায়।
সভা শেষে জেলা সভাধিপতি দেবু টুডু বলেন, “তফসিলি জাতি, উপজাতির মানুষ যে সব পঞ্চায়েতে বেশি প্রথমে সেগুলিকেই সভার জন্য বাছা হচ্ছে। পরের সভা হবে ২৬ নভেম্বর, আউশগ্রামে।” তাঁর দাবি, কিছু সমস্যা ওখানেই মেটানো হবে। বাকিগুলির ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
|