শুধু ধর্ম নয়, ইতিহাসের সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে শান্তিপুরের রাস। বারো ভুঁইঞা প্রতাপাদিত্য পুরীর রাজা ইন্দ্রদুম্নের আমলে পূজিত দোলগোবিন্দের বিগ্রহ যশোরে নিয়ে আসেন। কিন্তু মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে প্রতাপাদিত্য সেই বিগ্রহ তুলে দেন বারো ভুঁইঞাদের গুরু অদ্বৈতাচার্যের বংশের উত্তর পুরুষ মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। তিনি সেই বিগ্রহকে শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধারমণ জিউ নামে প্রতিষ্ঠা করলেন। কিন্তু মথুরেশ গোস্বামীর মৃত্যুর পর একদিন হঠাৎ করে চুরি হয়ে গেল সেই রাধারমণ জিউ এর বিগ্রহ। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর দিগনগরের এক বিল থেকে উদ্ধার হয় সেই বিগ্রহ। এই ঘটনায় গোস্বামী পরিবারের সদস্যদের মনে হয়, শ্রীকৃষ্ণ এখানে একা আছেন বলেই তাঁর কষ্ট হচ্ছে। আর তাই প্রতিষ্ঠা করা হল রাধিকা মূর্তি। রাসের দিনে মিলিত হয় সেই দুই মূর্তি। গোস্বামীদের শিষ্য খাঁ চৌধুরী বাড়ি থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, ওই যুগলমূর্তি শোভাযাত্রা করে দেখানো হোক শহরবাসীদের। মূলত তাঁদেরই উদ্যোগে বের হয় শোভাযাত্রা। শুরু হয় ভাঙারাস। |
শান্তিপুরের আগমেশ্বরীতলায় রাসের মণ্ডপ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য। |
লক্ষ মানুষের ভিড়ে শান্তিপুরের রাস প্রকৃত অর্থেই জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। কান পাতলেই শান্তিপুরের রাস নিয়ে নানা কাহিনি শোনা যায়। বড় গোস্বামী বাড়ির অন্যতম সদস্য সত্যনারায়ণ গোস্বামী বলেন, “অদ্বৈতাচার্যের হাত দিয়েই শুরু হয় রাসের।”
বর্তমানে প্রায় ৩০টি বিগ্রহবাড়ি সহ প্রায় দেড়শোটি রাস হয়। এদের সকলেই কিন্তু ভাঙারাসে যোগ দেয় না। ভাঙারাসে ১৭টি বিগ্রহ বাড়ি সহ ৫৭টি বারোয়ারি যোগ দেয়। তবে শান্তিপুর ক্রমশ মেতে উঠছে থিমের রাসে। আর সেই সব থিমের টানে জেলার বাইরে থেকেও বহু মানুষ ভিড় করছেন শান্তিপুরের রাসে। এ বার বড় গোস্বামীপাড়া বারোয়ারি তৈরি করেছে সমুদ্রের তলদেশ। আবার এসটিবি ইউথ ক্লাব কাঠের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করেছে অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র। গোডাউনপাড়া যুবমুক্তি সঙ্ঘের প্যারিসের মিউজিয়াম, ঘোষপাড়া বারোয়ারির গ্রামের দৃশ্য, আগমেশ্বরী তলা ইয়ং স্টাফের ‘স্বর্গ এ বার হাতের মুঠোয়’ থিম দর্শকদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করবে। ওয়াইএমএসএ এর জঙ্গলমহল, রাধানগর গাবতলার ভুলভুলাইয়া, কামারপাড়া বারোয়ারির সমুদ্র, ঠাকুরপাড়া যুবকবৃন্দের গুম্ফা, বাইগাছি সত্যনারায়ণের নেপালের বৌদ্ধ মন্দির, শ্যামবাজার যুবকবৃন্দের রাজস্থানের বৌদ্ধ মন্দির বেশ নজর কাড়ে। লক্ষতলা পাড়া বারোয়ারির থিম ‘কাল্পনিক’। |
শান্তিপুরে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়িতে রাস উৎসব।—নিজস্ব চিত্র। |
তিলিপাড়া মনসাতলা বারোয়ারি ঝিনুক দিয়ে তৈরি করেছে রাধা-কৃষ্ণ মন্দির, চৌগাছা প্যারাডাইস ক্লাব তৈরি করেছে দার্জিলিং এর কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ কলোনির রাজস্থানের অক্ষয়ধাম, এল কে মিত্র রোডের ঘোষ পাড়া বারোয়ারির ধানের গোলা, তামাচিকা পাড়া বারোয়ারির বেঙ্গালুরুর গণেশ মন্দির, গোস্বামী পাড়া লেনের ফ্রেন্ডস স্টার এর সবুজায়ন, রামনগরপাড়া আদর্শ ক্লাবের বাবুই পাখির বাসা এ বারের রাসে বিশেষ ভাবে নজর কেড়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কত কিছু। উৎসবের আঙিনায় বাড়ে জৌলুস, আলোর রোশনাই। আর চোখের সামনে যাঁরা সেই বদলে যাওয়াকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁরা এই রঙিন উৎসবের মাঝেও স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান। খুঁজে ফেরেন শৈশবের দিনগুলি। ৭৬ বছরের লেখক পুর্ণেন্দুনাথ নাথ তাঁদেরই একজন। পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, “সেই গ্যাসের আলো, হাওয়া মালাই, ময়ূরপঙ্খী গান সে সব আর কোথাও দেখি না। এখন রাসের জৌলুস, আলোর রোশনাই বাড়লেও ভক্তি কমছে।” নবীন, প্রবীণ সকলকে নিয়েই এগিয়ে চলে শান্তিপুরের রাস। |