রবিবার বিকেল সওয়া চারটে। ভারতীয় দলের ব্লেজারে শেষ বারের মতো সাংবাদিক সম্মেলনে বসে পড়লেন সচিন রমেশ তেন্ডুলকর। যেখানে রাশি রাশি প্রশ্ন নিয়ে মিডিয়ার ‘সচিন, সচিন’ চিৎকারে কখনও কখনও চরম বিভ্রান্তও হয়ে পড়লেন তিনি। ‘প্লিজ, এক এক জন করে জিজ্ঞেস করুন’ বলাতেও লাভ হল না। বাধ্য হয়ে আয়োজকদের শেষ করে দিতে হল প্রশ্নোত্তর-পর্ব। তবু তার আগের পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ক্রিকেট-কিংবদন্তি যা যা বলে গেলেন...
প্রশ্ন: আপনি ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ায় বলা হচ্ছে, বহু লোকের শৈশবের মৃত্যুও একই সঙ্গে ঘটে গেল। যাঁরা আপনার প্রজন্মের। কথাটা ভাবলে কী মনে হচ্ছে?
সচিন: ওয়েল, আমি লোককে বলতে শুনেছি যে চল্লিশ থেকে নাকি নতুন জীবন শুরু হয়। নতুন করে কুড়ি বছরের শুরু নাকি চল্লিশ থেকে হয়। আপনাদের যদি অসুবিধে না হয়, তা হলে আমার নিজের বয়সটা এখন কুড়ি বলে মনে হচ্ছে (হাসি)। আসলে ক্রিকেট মাঠে থাকার সময় আমার মধ্যে শিশুসুলভ ব্যাপারগুলো কাজ করত। যে অফুরান শক্তি আর হাসিখুশি ভাবটা সবার মধ্যে থাকা উচিত।
প্র: গত চব্বিশ বছরে ক্রিকেট কেরিয়ারে প্রচুর মাইলস্টোন আপনি ছুঁয়েছেন। প্রচুর চড়াই-উতরাই দেখেছেন। কোন মুহূর্তটা সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়?
সচিন: অবশ্যই বিশ্বকাপ জয়। বাইশ বছর আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ওই মুহূর্তের স্বাদটা পাওয়ার জন্য। শনিবারের ওয়াংখেড়েও প্রচণ্ড স্পেশ্যাল হয়ে থাকবে আমার জীবনে। যে ভাবে দর্শকরা নিজেদের উজাড় করে দিলেন, ভাবা যায় না। আমি ওঁদের হৃদয় থেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। |
প্র: আর উতরাই?
সচিন: ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ। অত ভাল খেলে, ট্রফির অত কাছাকাছি পৌঁছেও ফাইনালে পারিনি।
প্র: অবসর নেবেন, ঠিক কোন পরিস্থিতিতে ভেবেছিলেন?
সচিন: শেষ কয়েক বছরে অবসর নিয়ে আমাকে প্রচুর প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি বরাবরই যার উত্তরে বলতাম, সময় এলে ঠিকই নিয়ে নেব। গত চব্বিশ বছরে আমাকে প্রচুর চোট-আঘাতের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। যেগুলো সামলে ওঠা খুব সহজ ছিল না। তার পর একটা সময় আসে যখন শরীর আপনাকে বলে যে, এ বার অত্যধিক চাপ পড়ে যাচ্ছে। এ বার থামা দরকার। আমার শরীর যে চাপ আর নিতে পারছিল না। ট্রেনিং সেশনে গিয়ে দেখলাম যে, যেটা আগে আমার সহজাত ভাবে আসত, তার জন্য এখন অনেক চেষ্টা চরিত্র করতে হচ্ছে। মনে হতে লাগল, ট্রেনিং থামিয়ে এ বার একটু টিভি দেখি। তার পরই নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করলাম। আমি তো বলব, ঠিক সময়ে সরে যাচ্ছি।
প্র: বিদায়ী টেস্ট ইনিংসে চুয়াত্তর রানের ইনিংস দেখে আপনার মা কী বললেন?
সচিন: প্রচণ্ড খুশি হয়েছেন। অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বোর্ডের কাছে আমি অনুরোধ করেছিলাম, শেষ টেস্টটা ওয়াংখেড়েতে দিতে। যাতে আমার মা আসতে পারেন খেলা দেখতে। যিনি কোনও দিন আমার একটা ম্যাচও মাঠে বসে দেখেননি। তবে ওয়াংখেড়েতে শেষ ম্যাচটা হলেও আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে, উনি শেষ পর্যন্ত আসতে পারবেন কি না। মুম্বই ক্রিকেট সংস্থাকে অনুরোধ করেছিলাম, গারওয়ারে গেস্ট হাউসে একটা ঘর মা-র জন্য রাখতে। কিন্তু মা দেখলাম, প্রেসিডেন্ট বক্সে বসেই পুরো ম্যাচটা দেখলেন। পরে যখন কথা বলতে গেলাম, দেখলাম মা-র চোখই অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
প্র: কিন্তু বিদায়ী টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো আপনাকে যুদ্ধটাই দিতে পারল না।
সচিন: প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমটা মোটেও খারাপ নয়। যথেষ্ট ভাল টিম ওরা। কিন্তু সব সময় সব কিছু তো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
প্র: (এ বার এক ব্রিটিশ সাংবাদিক) আপনি গত চব্বিশ বছরে এত দুর্ধর্ষ সব ইনিংস খেলেছেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোন দু’টো সেঞ্চুরি সেরা?
সচিন: ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আমার প্রথম সেঞ্চুরি। আর চেন্নাইয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৭৪ করার সময় যেটা হয়েছিল।
প্র: শোনা যায়, আপনি এক সময় বলতেন চাপ আপনার কাছে আশীর্বাদ। আর চোট হচ্ছে গুড লাক। সত্যি?
সচিন: চোট গুড লাক, এটাও মোটেও কখনও বলিনি। বরং বিভিন্ন সময়ে এত ধরনের চোট পেয়েছি যে, কী বলব। প্রত্যেকটা আলাদা। কোনওটার সঙ্গে কোনওটার মিল নেই। টেনিস এলবোর সময় তো মনে হয়েছিল যে ক্রিকেটটা আর কোনও দিনই বুঝি খেলা হবে না। অর্জুনের প্লাস্টিক ব্যাটও তখন তুলতে পারতাম না। দশ-বারো বছরের বিরুদ্ধে খেলার সময় শট নিতে গিয়ে দেখতাম যে, দশ-পনেরো গজের বেশি বল যাচ্ছে না। তখন সত্যি মনে হয়েছিল যে এ বার আমাকে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হবে।
প্র: আপনি এত কোচের অধীনে খেলেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য কোনটা সঠিক বলে আপনার মনে হয়? দেশজ কোচ? নাকি বিদেশি কোচ?
সচিন: আ কোচ ইজ আ কোচ। সে কোথা থেকে এল সেটা বড় নয়। কোচ এমন কেউ হবে, যার কাছে ক্রিকেটাররা নিজের সমস্যা খুলে বলতে পারবে। কোচ-ক্রিকেটারের সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতাটা খুব দরকার। যাতে প্লেয়ার নিশ্চিন্ত থাকতে পারে যে, তার কথা বাইরে বেরোবে না। কেউ জানবে না।
প্র: আর বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে কার খেলা আপনাকে সবচেয়ে প্রভাবিত করে?
সচিন: আমি সবার খেলাই সমান উপভোগ করি। সবার সাফল্যই সমান উপভোগ করি। কারণ ক্রিকেটটা টিম স্পোর্ট। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের নয়।
প্র: ভবিষ্যতে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি খুলছেন?
সচিন: ভাল প্রশ্ন। অবসর নেওয়ার আগেও আমি অনেক সময় অনূর্ধ্ব-উনিশ ক্রিকেটারদের সঙ্গে কাটিয়েছি। জুনিয়রদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে ভালই লাগে। আমি সেটা করতেও চাই। কিন্তু সবাইকে জানিয়ে নয়। অন্তরালে। |