দীর্ঘ ক্রিকেটজীবনের কড়া অনুশাসন মেনে আজও তাঁর ভোরে ঘুম ভেঙেছে। ভেঙেছে ঠিক ছ’টা পঞ্চাশে। উঠে বিছানা ছেড়েছেন, ছেড়ে মনে পড়েছে, তোয়ালেটা
নিয়ে স্নানে যাওয়ার তাড়া তো আর নেই।
রবিবার থেকে নেট সেশন ব্যাপারটাই যে অতীত!
অবসরের রাতে অনেকটা সময় বসে কাটিয়েছেন একাকী। ক্রিকেট তাঁর কাছে এত দিনের ধর্ম ছিল। নিজের ভাষায়, ‘অক্সিজেন’। জন্মের পর চল্লিশ বছরের তিরিশটা চলে গিয়েছে যে সাধনার পিছনে, খরচ হয়েছে জীবনের সিংহভাগ, ওয়াংখেড়ের তিনটে দিন যদি এক প্রবল ঝটকায় সে সবে সমাপ্তি ঘোষণা করে, যদি শুনিয়ে দেয় অমোঘ বার্তা ‘তুমি এ বার অতীত’, বিশ্বাস হয় না। তাঁরও হয়নি। গভীর রাত পর্যন্ত নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আশাবাদে ভুগে নিজেকে নিজে বলেছেন, “আমি আর ক্রিকেট খেলব না হতে পারে না। খেলব, কোথাও না কোথাও ক্রিকেট আমি ঠিক খেলব...।” |
কে জানত, রবিবার ভোর ছ’টা পঞ্চাশে সেই স্বপ্নটাও শেষ হবে! ঘুম থেকে উঠে বসে সচিন রমেশ তেন্ডুলকর দেখবেন তিনি আর ‘ঈশ্বর’ নন। তিনি রবিবার থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক রক্তমাংসের মানুষ, যাঁকে উঠে চা বানাতে হল। স্ত্রীকে নিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসতে হল। উত্তর দিতে হল দেশজুড়ে ‘আত্মীয়’দের এসএমএসের। নিজের ডিনার পার্টির নিমন্ত্রণের কার্ডগুলো ঠিকঠাক গেল কি না, দেখতে হল। পরিচিত সিএবি কর্তা এলে বলতে হল আমি একটু বাইরে থেকে ক’টা দিন ঘুরে আসি। তার পর যাই আপনার ক্লাবে?
আপনি ক্রিকেট ভালবাসুন চাই না বাসুন, আপনি ক্রিকেট-ঈশ্বরের একনিষ্ঠ ভক্ত হোন চাই না হোন, মেরিন ড্রাইভের পার্শ্ববর্তী হোটেলের সচিন তেন্ডুলকরকে দেখলে বোধহয় আজ আরও এক বার বাষ্প জমত। প্রবল রসনা-রসিক তেন্ডুলকরকে যদি বলতে শোনা যায়, “এ বার নিশ্চিন্তে রোজ একটা করে চিজ কেক
খেতে পারব,” চোখের কোণ
আরও এক বার ভিজত না কি? তাঁর শাশুড়ি ইতিমধ্যেই এক সাক্ষাৎকারে বলে রেখেছেন যে, সচিন এমন কোনও জায়গায় হয়তো এর পর বেড়াতে চলে যাবেন, যেখানে ক্রিকেট কাকে বলে কেউ জানে না। মানে, যেখানে কেউ তাঁকে চিনবে না। কেউ জিজ্ঞেস করবে না আরে, আপনি সচিন তেন্ডুলকর না!
এবং ধন্য মরাঠির কাঠিন্য। ধন্য মরাঠির আবেগ চেপে রাখার ঐশ্বরিক ক্ষমতা। অবসর-পরবর্তী জীবন নিয়ে যে ভাবে রবিবার দেশ-বিদেশের মিডিয়ার নিরন্তর খোঁচাখুঁচি আরও এক বার শুরু হয়েছিল, জবাব দিতে দিতে যদি সদ্য-প্রাক্তনের চোখ আবার চিকচিক করত, দোষ দেওয়া যেত না। এ বার আপনি কী করবেন? ওয়াংখেড়েতে কান্নাকাটির সময় মনে-মনে কী চলছিল একটু বলবেন? আপনার শেষ ইনিংসটা দেখে মা কী বললেন? অন্তরাত্মা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়া সব প্রশ্ন। বিশেষ করে বিদায়ের সবে চব্বিশ ঘণ্টা যখন পেরিয়েছে, যখন তাঁর শরীর থেকে ক্রিকেটীয় আত্মা বিছিন্ন হয়েছে সদ্য, যখন কয়েক ঘণ্টা আগে ক্রিকেট-কফিনে ঘুমিয়ে পড়েছে তাঁর ব্যাট।
উত্তরে একটাও কপিবুক ডিফেন্স থাকে না। বরং থাকে রসবোধের স্ট্রেটড্রাইভ। আগামীর প্রশ্নে যেখানে জবাব আসে, “চব্বিশ বছর খেলার পর চব্বিশ ঘণ্টা হয়েছে। চব্বিশ দিন পরে বলি?” নতুন ভারত নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ঠাট্টা চলে, “আমি যখন ক্রিকেটটা শুরু করি, তখনও ভুবনেশ্বর কুমার জন্মায়নি। ওদের বলতাম, আমি ড্রেসিংরুমে ঢুকলে গুডমর্নিং স্যর বলবে!” যেখানে ভারতরত্ন খেতাব উৎসর্গ তিনি শুধু নিজের মা-কে করেন না, করেন ভারতবর্ষের কোটি কোটি সন্তানের মা-কে। বলে ফেলেন, “দেশের সমস্ত মায়ের সঙ্গে খেতাবটা ভাগ করে নিলাম।”
আসলে শনিবারের ওয়াংখেড়ে তাঁর জীবনে এমন একটা দিন ছিল, যার আবেগ সম্পর্কে কোনও পূর্ব ধারণা ছিল না সচিনের। দেশের আর পাঁচটা পরিবারে যেমন হয়, ঠিক তেমনই তাঁর বাড়িতেও বিগ্রহের কাছে মিষ্টি দেওয়া হত ম্যাচের দিন সন্তানের সাফল্য কামনায়। গত কালও প্রেসিডেন্টস বক্সে মা রজনী তেন্ডুলকরের সঙ্গে দেখা করতে গেলে শুনে আসেন, কেরিয়ারের শেষ দিনেও তাঁর কথা ভেবে দেবতার পায়ে মিষ্টি দেওয়া হয়েছে। তার উপর ওয়াংখেড়ের আবহ। অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিনে ভাবতে পারেননি, এতটা আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়বেন। আক্রান্ত হয়েছেন, যখন টিমমেটরা তাঁকে বিদায়-সংবর্ধনা দিয়েছে। আক্রান্ত হয়েছেন, যখন বাইশ গজের কাছে শেষ বার ফিরে গিয়ে একা একা কথা বলছিলেন (যা আজ নিজেই ফাঁস করলেন)। আক্রান্ত হয়েছেন, মাটি ছুঁয়ে সশ্রদ্ধ প্রণামে আশীর্বাদ চাওয়ার সময়। পিচ যে তাঁর কাছে মন্দিরের মতো। ওয়াংখেড়ের দিকে একটা সময় তো তাকাতেও পারছিলেন না। কেউ যদি তাঁর কান্না দেখে ফেলে। কেউ যদি পড়ে ফেলে তাঁর মনের ভাবাবেগ। এর পর তো ভারতের জার্সিতে আর নামা হবে না। এই শেষ। এর পর অখণ্ড অবসর। “কালকের ব্যাপারটা ঠিক ভাষায় বোঝানো যাবে না। প্রচণ্ড ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম,” বলছিলেন সচিন। নিজেকে সামলে রবিবার বিকেলে যিনি আরব সাগরের মতো শান্ত। এবং ভারতীয় দলের ব্লেজার পরা সৌম্যদর্শন ভদ্রলোকের কথাবার্তা থেকে আরও একটা জিনিস পরিষ্কার। তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের সূর্যাস্ত হতে পারে, কিন্তু জাতীয়তাবোধের নয়। ব্যাটটা কিটব্যাগে বরাবরের মতো ঢুকে গেলেও গ্রিপ থেকে কেউ কোনও দিন তেরঙ্গার রংটা তুলতে পারবে না।
নইলে আর বলবেন কেন, সশরীরে না পারলেও মনে মনে তিনি নামবেন ভারতের জন্য। প্রার্থনা করবেন ভারতের জয়ের। যে কোনও খেলায়, যে কোনও ময়দানে। সেটা ক্রিকেট হোক, হা-ডু-ডু হোক, কিচ্ছু যায় আসে না!
|