|
|
|
|
শাশ্বতর জীবনীটা আমিই লিখব |
‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ছবিতে
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের অল্টার ইগো এক জিনি। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন রজতাভ দত্ত।
কিন্তু তাঁর নিজের জীবনে যদি হঠাৎ জিনি এসে হাজির হয়, কী করবেন? শুনলেন সংযুক্তা বসু |
অনীক দত্তের ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ের জিনি ওরফে প্রদীপ দত্তকে নিয়ে দর্শকের কৌতূহলের শেষ নেই। আর আপনি কিনা এখন উত্তরবঙ্গে। মিস করছেন না এই উত্তেজনা?
দর্শকদের সমালোচনা বা প্রশংসা যাই পাই, সেটা টাটকা পেতেই ভাল লাগে। শিল্পীদের তো এইটুকুই আছে। কিন্তু পরের ছবির শু্যটিংয়ের কথা দেওয়া থাকলে সেটা করতেই হবে। যে কোনও ছবিতে কাজ করার পর মনে হয়, আমার যা কিছু দেখানোর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। সেটা থেকে ভয়ঙ্কর টেনশন হয়। টেনশন হয় বলেই পরের কাজে নতুন উদ্যমে লেগে পড়ি।
এ পর্যন্ত যত ভিলেন চরিত্র করেছেন ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ের জিনিকে কি সেরা ভিলেন মনে হচ্ছে এখন?
জিনি মোটেই ভিলেন নয়। বলা যেতে পারে, আমার অভিনয়-জীবনে একটা স্মরণীয় চরিত্র হয়ে থাকবে সে।
ভিলেন নয়? মানুষের মনের প্রলোভনের প্রতীক আপনার চরিত্র....
না, জিনির একটা নীতি আছে। দর্শন আছে। সে জানে পার্থিব সব দুর্মূল্য আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারলেও সে প্রেম-ভালবাসা, মানবিক অনুভূতি কিনে দিতে পারে না। বরং এ ছবিতে খলনায়ক যদি কেউ থেকে থাকে, সেটা অপুর (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়) চরিত্র। মানে ছা-পোষা অনিলাভ। ঘুষ খায়, ব্যভিচার করতে চায়, এবং আরও...
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক অনেক দিনের। ‘এক আকাশের নীচে’ সিরিয়ালে দীর্ঘতম কাজ একসঙ্গে। সেই শাশ্বত মধ্যবয়সে এসে দুর্দান্ত অভিনয় ক্ষমতা প্রমাণ করলেন। ঈর্ষা হয়?
ঈষা কেন হবে? ও আমার বন্ধু ‘এক আকাশের নীচে’র অনেক আগে থেকে। অসাধারণ অভিনেতা, এটা সব সময় মনে হত। কিন্তু ‘কহানি’তে কাজ করে সেই স্বীকৃতি এল অনেক দেরিতে। এই জায়গা পাওয়ার যোগ্যতা ও বহু দিন আগেই অর্জন করেছিল। ও আমার গলায় গলায় বন্ধু। আমি তো মাঝে মাঝে বলি, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের জীবনীটা আমিই লিখব। ওর অনেক দস্যিপনার সাক্ষীও আমি। তখন অপু রসিকতা করে বলে, “একদম না। সেটা যদি করিস তা হলে বুঝব তুই শেষকালে আমাকে নিয়েও ভিলেনগিরি করছিস।’’ হা হা হা।
এই যে আপনারা ‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ে একসঙ্গে অভিনয় করলেন এটা কি তা হলে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি, না অভিনয়ের টক্কর?
কোলাকুলি বা টক্কর কোনওটাই নয়। টক্কর যুদ্ধে হয়। অভিনয় হল শিল্প।
পরিচালক অনীক কেন এত অভিনেতা থাকতে আপনাকে জিনির চরিত্রে নিলেন এটা জানার কৌতূহল হয়নি?
যত দূর শুনেছি আমার আর অপুর অভিনয়ের ওপর ওঁর আস্থা ছিল বলেই নিয়েছেন। কারণ এ ছবিতে এত রকম ভাবনা-চিন্তার ব্যাপার ছিল যে অনীক অভিনয়ের ব্যাপারে খানিকটা নিশ্চিন্ত থাকতে চেয়েছেন। কেউ-কেউ ভাবতে পারেন আমার চেহারাটার জন্যই হয়তো আমাকে নেওয়া। কিন্তু সেটা ভাবলে আমার খারাপ লাগে। কোথাও অভিনয়ের জায়গাটাকে খর্ব করা হবে। |
|
একশো পঁচিশটার বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। কিন্তু অধিকাংশই হয় ভিলেনের রোলে, নয় খলনায়কসম মেয়ের বাবার রোলে। একঘেয়ে লাগে না?
না। প্রতিটা ছবিতে আমি চরিত্রকে নতুন করে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি। একটা ছবির মেয়ের বাবার সঙ্গে আর একটা ছবির মেয়ের বাবার বা ভিলেনের মধ্যে যাতে তফাত থাকে তার জন্য ইমপ্রোভাইজ করার চেষ্টা করি নতুন ধরনের ম্যানারিজম বা অভিব্যক্তি।
সাধারণ মানুষ, কাকা, পিসে, জ্যাঠা, অফিসের কেরানি চরিত্র তো কত রকম হয়... সে সবে অভিনয় করতে ইচ্ছে করে না?
মেনস্ট্রিমে এই সব সাধারণ চরিত্রের কোনও জেল্লা থাকে না। কিন্তু পরপর বেশ কয়েকটা অন্য ধরনের ছবি করেছি যেখানে বাংলার মাস্টার, কলসেন্টারের কর্মী, কিংবা রাইটার্সের কেরানি সেজেছি। তবে এই প্রশ্নটা আপনি আমাকে করতেন না, যদি আমি হিরোর রোল করতাম। হিরো ছাড়া অন্য রোল করলেই দর্শক বা আপনাদের মনে হয়এই শিল্পী হয়তো দুঃখে আছে। মেনস্ট্রিম ছবিতে একজন ভিলেন বা দাপুটে মেয়ের বাবার মধ্যে একটা জৌলুস থাকে। সে হয়তো হেলিকপ্টার থেকে নামছে, বা বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে, গুন্ডার সাহায্য নিয়ে হিরোকে মার খাওয়াচ্ছেএ সবের মধ্যেও একটা পাওয়ার ফ্যাক্টর থাকে। হিরোর মতোই। এটাই অনেকে বুঝতে চান না। আর এর বাইরে যদি কোনও চরিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছে করে, তা হলে আমার নাটক আছে।
কিন্তু ইদানীং নাটকেও তো তেমন ঘনঘন অভিনয় করছেন না।
‘সেই সুমৌলি’ নাটকে অভিনয় করছি নিয়মিত। আমার শু্যটিংয়ের চাপ থাকে। তাই একাধিক নাটকের কমিটমেন্টে যাওয়া মুশকিল।
এক সময় নাটকে অনেক গান গাইতেন, সুর করতেন। এ বার ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ছবিতেও গান গাইলেন। সিনেমায় গান গাওয়া একটা নতুন ধরনের প্রাপ্তি তো হলই...
এক সময় আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত, পুরাতনী বাংলা গান আর ক্ল্যাসিকাল শিখেছি। তখন নাটকে আমাকে সঙ্গীতের দিকটা দেখতে বলা হত। আমি ভাবতাম আমার অভিনয় ঠিক নেই বলেই বোধ হয় গানের দিকটা সামলাতে দেওয়া হচ্ছে। শুধু একটাই দুঃখ থেকে গেল যখন আমার গলাটা ভাল ছিল, নিয়মিত চর্চা ছিল, তখন ছবিতে গান গাওয়ার কোনও অফার পাইনি।
ফেরা যাক অভিনয়ে। আজকাল নতুন পরিচালকেরা নানা ধরনের ছবি করছেন। গতানুগতিক চরিত্রের বাইরে তাঁরা কি আপনাকে ভাবতে পারছেন না?
তা কেন? আমি কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘উড়ো চিঠি’ এবং মৈনাক ভৌমিকের ‘আমরা’তে অভিনয় করেছি। সৃজিত মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে কাজের। হয়তো আগামী দিনে হবে। সত্যি কথা বলতে কী, অন্য ধরনের ছবির জগৎটা কিন্তু আমার কাছে অপরিচিত নয়। তপন সিংহ, গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, সন্দীপ রায়ের ছবিতে কাজ করেছি।
আর একটা কথা হল, যেহেতু অন্য ধরনের ছবিতাই আমি কম রেমুনারেশনে কাজ করব এমনটা হবে না। কারণ তা হলে যে হাউজের হয়ে কাজ করতে চলেছি তাঁরা ধরে নেবেন আমি অন্য ধরনের চরিত্র করার জন্য কম পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি। আমাকে আমার সম্মানজনক পারিশ্রমিকটা দিতেই হবে, সেটা আমি যে রকম কাজই করি না কেন।
আপনি তো বলেন যে আপনার চাহিদা কম। তা হলে এই আকাশছোঁয়া দাবি কেন?
দাবি নয়। পারিশ্রমিকটা সম্মানের মাপকাঠি তো বটেই।
আপনার সঙ্গে দেখা হলে যদি কখনও জিজ্ঞাসা করা হয় যে কেমন আছেন? আপনি বলে থাকেন, ‘আমি সব সময়ই ভাল থাকি।’ এই ভাল থাকার বীজমন্ত্রটা কী?
শুধু এইটাই ভাবা যে আজকে আমি যা পেয়েছি তা অনেক পেয়েছি। অতীতে যখন টাকাপয়সার টানাপোড়েনের মধ্যে থেকেছি, ঠিকঠাক কাজের সুযোগ আসেনি, তখনও প্রত্যেকটা দিনের শেষে নিজেকে বলেছিদারুণ একটা দিন কাটালাম। আজও আমার ঠিক তেমনটাই মনে হয়।
জীবনের প্রথম দিনগুলো অর্থকষ্টে কাটলেও এখন আপনার অবস্থা সচ্ছল। কী করেন রোজগারের টাকায়। কনজিউমারিজমের কবলে পড়েন?
না। পড়ি না। নিজের সাধ্য এবং সাধ জানি। তাই পেন্টহাউজ কিনে বা পেছনলম্বা গাড়ি কিনে ইএমআই-য়ে ডুবে যেতে চাই না। রোজগারের টাকার অনেকটাই সঞ্চয়ে থাকে তা এই কথা ভেবে যে, আমি যে-অর্থকষ্ট পেয়েছি তা যেন আমার স্ত্রী-মেয়েকে কোনও দিন পেতে না হয়। বাকি টাকায় বইপত্র কিনি। বেড়াতে যাই। খাওয়াদাওয়া করি। |
|
‘আশ্চর্য প্রদীপ’য়ে শাশ্বত আর রজতাভ |
মানে ইটিং আউট?
বাইরে খাওয়া মানেই যে বড় বড় হোটেলে গিয়ে খাওয়া, তাও নয়। অনেক সাধারণ জায়গায় খুব ভাল খাবার পাওয়া যায়। সে সবের খোঁজ রাখি। তবে বাইরে বেশি খেলে শরীরের ওপর চাপ পড়ে। সেটা মাথায় রাখি।
আপনার শরীর এখন কেমন? একটা পায়ে যে ডিফেক্ট ছিল, সেটা তো আছে বলে আর মনে হয় না।
হ্যাঁ, পা-টা আড়াই ইঞ্চি শ্রিংক করে গিয়েছিল। অপারেশনের পর এখন একদম ঠিক আছি। সেই সময় খুব ব্যথা হত। এখন তো ডাক্তার বলেছেন জিমে যেতে, মার্শাল আর্টও করতে।
একটা সময় অনেক বেনিয়মের জীবন কাটিয়েছেন। আর তার পর এখন শুধুই দাম্পত্য। একঘেয়ে লাগে না? মনে হয় নাআর এক জন কেউ থাকলে ভাল হত?
আমি, আমার বৌ-মেয়েকে নিয়ে বেশ সুখে আছি। কোয়ালিটি টাইম কাটাই। প্রচুর বাউন্ডুলেপনা করেছি। কলকাতা শহরের অলিগলি-পাকস্থলী আমার জানা। আজ থিতু হতে চাই। আরও একটা কথা, ফেসবুক করি না। আমার সময় অনেক বেঁচে যায়। আমার বাড়ির চালে কাক কি চড়াই বসেছে এটা ফেসবুকে লেখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তার থেকে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে পরিবারকে সময় দিয়ে বা বই পড়ে অনেক আনন্দ পাই।
আচ্ছা ধরুন, কাল সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন বেডসাইড টেবিলে একটা আশ্চর্য প্রদীপ রাখা। আর সামনে দাঁড়িয়ে তার দৈত্য বা জিনি। সে আপনাকে সব জাগতিক সুখ পূর্ণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিল। কী করবেন?
আমি বলব, আপনি আসতে পারেন।
অন্য কারও হয়তো আপনাকে দরকার আছে। প্লিজ... |
ছবি: কৌশিক সরকার। |
|
|
|
|
|