|
|
|
|
‘ব্যান্ড’ বৃহন্নলা |
প্রচার-বিপণনের ঝড় সামলাতে হিজড়াদের ‘ব্যান্ড’। চলছে
ভিজিটিং কার্ড বিলি। লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
হাসপাতাল, নার্সিংহোম, চেনা-পরিচিত পাড়া, পরিচিত মানুষজনের মধ্যে ঝকঝকে ভিজিটিং কার্ড বিলি হচ্ছে, পড়ছে পোস্টার! তাতে দস্তুরমতো ছবি, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা দেওয়া। উৎসব, অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণের জন্য চাইলেই পছন্দের ‘হিজড়া ব্যান্ড’ বুকিং করতে পারেন। শুধু নম্বর ঘোরানোর অপেক্ষা। কোন এলাকায় কোন দলকে পাওয়া যাবে সে সবও কার্ডে বিশদে রয়েছে। তলায় রয়েছে সতর্কবার্তা‘ডুপ্লিকেট হিজড়া হইতে সাবধান!’
ঐতিহ্য, পরম্পরা ধুয়ে আর চলছে না। যুগোপযোগী হতে হবে। তাই অসংগঠিত ভাবে এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে নাচগানের দিন শেষ। বৃহন্নলারা আবির্ভূত ‘ব্যান্ড’ নিয়ে। আজ্ঞে হ্যাঁ। নাচ-গানের সংগঠন বা কয়্যারের ধাঁচে অতি পেশাদার, সংগঠিত একাধিক ‘বৃহন্নলা ব্যান্ড’ তৈরি হয়েছে এ রাজ্যের আনাচে-কানাচে। মনোরমা কিন্নর দল, মায়া ও মিঠু-র দল, মা গুরু বেলা হিজড়ার দল, ঊষা হিজড়ার দল, মায়ামাসির দল, সুন্দরী হিজড়ার দল, রূপা হিজড়ার দল একেবারে বিজ্ঞাপন দিয়ে বায়না নিচ্ছেন। নতুন বাচ্চা, বিয়ে, রিসেপশন, বিজয়া সম্মেলন, ছট পুজো, শীতলা পুজো, কার্তিক পুজো, ব্যবসার গদির উদ্বোধন, নতুন গাড়ি কেনা, গর্ভবতীর সাধ-অনুষ্ঠান, গৃহপ্রবেশআপনি ডাকলে তবেই হিজড়ারা অনুষ্ঠান করতে যাবেন। জবরদস্তি দরকষাকষি, অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরির সুযোগই নেই। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা ছাপানো রেটচার্ট প্রত্যেক ব্যান্ডের। প্রত্যেকের এলাকাও ভাগ করা আছে। যেমন, ঊষা হিজড়ার ব্যান্ডের এলাকা হাওড়া আর সুন্দরী হিজড়ার রাজারহাট-নিউটাউন। পরিষ্কার বোঝাপড়া রয়েছে এঁদের মধ্যে। একের এলাকায় অন্যরা বায়না নেবেন না।
যদি বলি নিঃশব্দে একটা সমাজবিপ্লব হচ্ছে, খুব ভুল হবে? সামাজিক ইতিহাসের ধারাটা একটু লক্ষ করুন। যে সম্প্রদায়কে নিয়ে চিরকালীন ‘ট্যাবু’, আমজনতার ধরাছোঁওয়ার বাইরে যাঁরা রহস্যময়, আনএক্সপ্লোর্ড, কখনও-কখনও বা ভীতিপ্রদ, তাঁরা এই ভাবে মিশে যেতে চাইছেন সমাজের স্বাভাবিক বহতা স্রোতে। সমাজতাত্ত্বিকেরা যার কারণকে বলছেন, নেহাতই ‘অর্থনৈতিক।’ সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় সঙ্গে যিনি আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। একটা সময় পর্যন্ত বিশেষ কিছু উৎসব-অনুষ্ঠানে হিজড়াদের অবারিত দ্বার ছিল। তাঁদের উপস্থিতি মঙ্গলময় বলে একটা বদ্ধমূল বিশ্বাসও ছিল। সেটাই ছিল হিজড়াদের আত্মবিশ্বাস, আর্থিক নিরাপত্তার জায়গা। যুগের সঙ্গে গৃহস্থের বাড়িতে হিজড়া-র গম্যতা এবং তাঁর মঙ্গল করার ক্ষমতা প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে। এই অবস্থায় রোজগারের বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া উপায় কি? |
|
‘বুলেট রাজা’য় রবি কিষণ। |
আরও একটা দিকের কথা বলছিলেন হিজড়া অপর্ণা। তিনি নিজে উচ্চশিক্ষিতা, জমিয়ে সংগঠন করেন। পাল্টা প্রশ্ন ছোড়েন, “কেন বাচ্চা নাচানো আর ছট পুজোর নাচের মধ্যে আধুনিক হিজড়া আটকে থাকবে? এখনকার দিনে অনেক হিজড়াই শিক্ষিতা, আলোকপ্রাপ্তা, আত্মবিশ্বাসী। তাঁরা সম্মান চান, নিজেদের নাচ-গানের প্রতিভার কদর চান, প্রতিষ্ঠা চান। লোকের বাড়ি অনাহুতের মতো গিয়ে কুকুরের মতো আচরণকে তাঁরা ঘেন্না করেন। তাঁদের কাছে শিল্প আঁকড়ে চলার রুচিশীল উপায় হল এই ধরনের দল বা ব্যান্ড তৈরি করা। জাতীয় স্তরেও আভিনা আহের নামে মুম্বইয়ের এক হিজড়া ‘ডান্সিং কুইন’ নামে ব্যান্ড তৈরি করেছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাঁরা হিজড়াদের অধিকার নিয়েও প্রচার চালান। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এটাই স্বাভাবিক।”
আর্থিক অনিশ্চয়তা থেকেই ‘ব্যান্ড’ গড়ে জীবনযুদ্ধ শুরুর কথা বলছিলেন মায়া-মিঠু হিজড়ার দলের অনিতামাসি। তাঁদের ব্যান্ড-এ প্রায় ২২ জন শিল্পী বা চ্যালা রয়েছেন। চেনা-পরিচিত সক্কলের কাছে ব্যান্ডের ভিজিটিং কার্ড দেওয়া রয়েছে। বলেন, “মারওয়াড়ি, বিহারিরা যে কোনও অনুষ্ঠানে ৫-৭ হাজার টাকা, জামাকাপড়, চাল-ডাল দেয়, আমাদের খুশ করে দেয়। বাঙালিদের খুব হাতটান। ওদের কাছে বায়না পাওয়া যায় না। আবার অনেকে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটে ঝামেলা বা পারিবারিক গোলমালেও আমাদের ব্যান্ড ভাড়া করে নিয়ে যায়। আমরা গিয়ে দাঁড়ালেই অনেকে ভয় পায় তো, তা-ই।”
অনিতা, টিনা, স্বপ্না মাসিদের কথায়, হিজড়াদের দলে এখন প্রচুর বেনোজল ঢুকে পড়েছে। অনেকে সম্পূর্ণ পুরুষ হয়েও হিজড়া সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যাল থেকে টাকা তুলছেন, দোকান-বাজারে প্রকৃত হিজড়াদের বখরায় ভাগ বসাচ্ছেন। এতে হিজড়াদের রোজগারে টান তো পড়বেই। বাধ্য হয়ে তাঁদের বিজ্ঞাপন বা ব্যান্ডের পথে হাঁটতে হচ্ছে।
হিজড়াদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন লড়াই করা রঞ্জিতা সিংহ সদ্য দিল্লিতে হিজড়াদের জাতীয় স্তরের কনফারেন্স সেরে ফিরেছেন। জানালেন, ২০০৩ সালে কর্নাটকের এক সংস্থা ভারতে হিজড়াদের অবস্থা নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। তাদের রিপোর্টে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল, ‘হিজড়া কমিউনিটি আর ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডিসঅ্যাপ্রুভড গ্রুপস ইন ইন্ডিয়ান সোসাইটি।’ ছবিটা এখনও বদলায়নি। মহেশ ভট্টের ‘তমন্না’-র মূল চরিত্র টিক্কু হোক কিংবা কল্পনা লাজমির ‘দরমিয়াঁ’-র ইম্মি বঞ্চনার বাস্তব ইতিবৃত্ত সেলুলয়েডের পর্দাতে এসেছে বারবার। এখনও তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা নেই, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট নেই। তাঁরা স্কুলে ভর্তি হতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন, চাকরি পেতে বাধা পান, ব্যবসার জন্য লোন পান না, হাসপাতালে গেলে যে কোনও বাহানায় তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়, একটা কোথাও তো তাঁরা ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করবেন। ব্যান্ড তৈরি, বিজ্ঞাপন দেওয়াটা হয়তো তারই শুরু।
পঞ্চান্ন বছরের মায়ামাসির আক্ষেপ, “এখন ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের যুগ। লোকের একটার বেশি ছেলেপিলে হয় না। আর যদি বা হয়, সব থাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে। সেখানে সিকিউরিটির লোকেরা আমাদের ঢুকতেই দেয় না। পেট চালাতে হবে তো। তাই নাচ-গানের দল খুলে ফাংশনের বায়না নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”
আর্থ-সামাজিক অধিকারের লড়াইয়ে ‘ব্যান্ড’ অস্ত্রে ক্রমশ শান দিচ্ছেন আধুনিক বৃহন্নলারা। |
|
|
|
|
|