ব্যাগ, ওড়না সামলে ঘরে ঢুকে পড়লেন এক দল তরুণী। ‘‘স্যার নতুন একটা কোর্সের ফর্ম দেওয়া হচ্ছে না কি?’’ মাম্পি মাহাতো, শবনম খাতুন, শান্তা বর্মন, তবসুম আরা আর তাঁদের বন্ধুরা খুঁটিয়ে জানলেন কম্পিউটার কোর্সে ঢুকতে গেলে কী করতে হবে, ফার্মাসিস্ট কোর্সে ভর্তিরই বা শর্ত কী। কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, কেউ বা বিএ পড়ছেন। চোখে স্বপ্ন, দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে।
আর তাই ওঁরা দল বেঁধে এসেছেন মসজিদে।
কোচবিহারের নতুন মসজিদ ২২৮ বছরের পুরনো। রাজার আমলের মসজিদ ভবনটির পাশে তৈরি হয়েছে নতুন চারতলা ভবন। সেখানেই চলছে নানা কোর্স। কম্পিউটারের ‘ও’ লেভেল, ফার্মাসির ডিপ্লোমা, স্কুল সার্ভিস কমিশনের কোচিং, আর সেই সঙ্গে আরবি, ঊর্দুতে ডিপ্লোমা কোর্স। দু’শো সংখ্যালঘু তরুণ এখান থেকে পুলিশ কনস্টেবল হওয়ার ট্রেনিং নিয়েছেন। কম্পিউটার কোর্স করে যাঁরা বেরিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই খাদ্য, প্রতিরক্ষা, বিদ্যুৎ দফতরে, কেউ বা ব্যাঙ্কে, প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছেন গর্বের সঙ্গে জানালেন মসজিদ কমিটির সদস্য বোসলে রহমান। পেশায় প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক রহমান জানালেন, ফার্মাসিস্ট কোর্স করে অনেকেই হেলথ সেন্টারগুলিতে কাজ করছেন, জেলা হাসপাতালেও কাজ পেয়েছেন দু’জন। |
কোচবিহারের উপ পুরপ্রধান আমিনা আহমেদ বলেন, “আমি অনেক মসজিদ দেখেছি, কিন্তু নতুন মসজিদ একেবারে ব্যাতিক্রমী। ঐতিহ্য ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে একটা নতুন আদর্শ তৈরি করেছে মসজিদ কমিটি।” পুরপ্রধান বীরেন কুণ্ডওু মনে করেন, নতুন মসজিদের কাজ ‘‘দৃষ্টান্তমূলক।”
কেন এই উদ্যোগ? বোসলে রহমান বলেন, ‘‘আমরা মুসলিম ছেলেমেয়েদের সমস্যাগুলো বুঝতে পারছিলাম। অনেক ছাত্র কোচবিহার শহরে পড়তে চায়, কিন্তু হস্টেল পায় না। অনেক মহিলা দূর থেকে চিকিৎসা করাতে আসেন। কিন্তু বিশ্রাম করার ঘর কিংবা ব্যবহারের মতো শৌচাগার পান না। অনেক তরুণ-তরুণী এমএ, বিএ পাশ করেও ভেবে পান না, কী কাজ করবেন। এঁদের জন্য আমরা সাধ্যমতো ব্যবস্থা করেছি এই মসজিদে।’’
মসজিদ-সংলগ্ন দোকান ভাড়া দিয়ে মাসে আট থেকে দশ লক্ষ টাকা আয় হয়। তা থেকেই চলে আর সব কাজ। ১২ জন ছাত্রের থাকা, রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে, ১৯টি কম্পিউটারে সকাল-বিকেল ট্রেনিং পাচ্ছেন ৮০ জন, ফার্মাসিস্ট কোর্স-এর জন্য নাম লিখিয়েছেন ১০০ জন। বেশ কয়েকটি ঝকঝকে ক্লাসরুম রয়েছে। ২৫ জন মহিলার নমাজ পড়া, বিশ্রাম নেওয়ার ঘর তৈরি রয়েছে। যদিও প্রায়ই তার দ্বিগুণ চলে আসেন মসজিদে। ছাদের উপরে তৈরি হয়েছে প্রায় ১৫০ মানুষের ‘কনফারেন্স-রুম’। মসজিদের নিজস্ব লাইব্রেরিতে ধর্ম বিষয়ক নানা বই যেমন আছে, তেমনই বাংলা সাহিত্য থেকে বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক, কম্পিউটারের ম্যানুয়াল থেকে শিক্ষক-প্রশিক্ষণের পাঠ্যবই, নানা পাক্ষিক-মাসিক পত্রিকা সবই মজুত। সকাল ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত একঝাঁক তরুণ-তরুণীর আনাগোনা মসজিদে। আসে স্কুল পড়ুয়ারাও। আল আমিন মিশন-সহ বেশ কিছু আবাসিক মিশনে ভর্তির পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এই মসজিদেই।
কিন্তু কম্পিউটার শিখতে মসজিদে কেন? পাতলাখাওয়ার জিনাত সর্দার বলল, “এখানে আসার জন্য বাড়ি থেকে কখনও ‘না’ শুনতে হয় না।” সুমিত্রা, দীপ্তি, মাম্পিদেরও একই কথা। “এখানে সকলে চেনাজানা, খুব আন্তরিক”, বলল ওরা। মসজিদে মেয়েদের কোনও ‘ড্রেস কোড’ নির্দিষ্ট করে দেওয়া নেই। তবে মেয়েরা ওড়না-সহ সালোয়ার কামিজ পরেই আসে।
আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আবদুর রহিম খান বলেন, “ভারতের আর কোনও মসজিদে মাদ্রাসা ছাড়া, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের কোনও ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানা নেই। মসজিদ মানেই কূপমণ্ডুকতা, এই ধারণা ভেঙে দিয়েছে নতুন মসজিদ।”
নতুন মসজিদের শিক্ষা প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর মহম্মদ মকলেসুর রহমান কেবল একটাই আক্ষেপ করলেন। সরকারি অনুদান পাওয়া একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে ক’দিন আগেও চলত ‘কেরিয়ার কাউন্সেলিং’। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ছিল দেখার মতো। সরকারি অনুদান বন্ধ হওয়ায় কাউন্সেলিং’ও বন্ধ। ‘‘ওটা আবার চালু করতে পারলে খুব ভাল হত’’, বললেন তিনি। |