প্রস্তাব গিয়েছিল ২০০৬ সালে। সেই মতো জায়গা ও লোকজনও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তাতে উৎসাহী হয়ে দু’তিনটি ফ্রিজ এবং কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পরে কেটে গিয়েছে সাত বছর। এর মধ্যে রাজ্যে সরকারও বদলে গিয়েছে। তবু আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাজ্যের প্রথম হার্ট ভাল্ভ ব্যাঙ্ক এখনও দিনের আলো দেখতে পায়নি!
অথচ, সরকারি তথ্যই বলছে, রাজ্যে এই মুহূর্তে এক লক্ষ মানুষের শরীরে হার্টের ভাল্ভ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন। বেসরকারি হাসপাতালে হার্টের একটি ভাল্ভ বসাতে ৩০ হাজার থেকে দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। অর্থের অভাবে সিংহভাগ মানুষই তা করাতে পারছেন না। সরকারি উদ্যোগে ব্যাঙ্ক তৈরি করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা হলে ভাল্ভ বসানোর খরচ দাঁড়াবে মাত্র কয়েক হাজার টাকা!
মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দান করা দেহ থেকে হার্টের ভাল্ভ তুলে ব্যাঙ্কে সংরক্ষণ করে রাখলে এক মাসের মধ্যে তা কোনও মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। রোগীর প্রাণ বাঁচাতে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সংরক্ষণ করে রাখার ব্যাঙ্ক কেন এখনও চালু করা গেল না, তার উত্তর জানা নেই কারও! বরং স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, আর জি করের পরে মেডিক্যালের পক্ষ থেকেও এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বাম আমলে। তারও পরিণতি হয়েছে একই।
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা অবশ্য এ নিয়ে বিশেষ কথা বলতে নারাজ। দফতরের সচিব পদে নতুন যোগ দেওয়ায় এই বিষয়ে তাঁর বিশেষ কিছু জানা নেই বলে জানিয়েছেন মলয় দে। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফাই, “সরকারি ব্যবস্থায় ফাইল চালাচালিতে সময় তো লাগবেই। হুট করে কাজ হয়ে যায় না।”
ভাল্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ে কর্তারা পরিষ্কার করে কিছু না বললেও স্বাস্থ্য ভবনের একাংশ এর মধ্যে অন্য কারণ খুঁজে পাচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, “এর পিছনে কৃত্রিম হার্ট ভাল্ভ প্রস্তুতকারী কোনও কোনও বহুজাতিক সংস্থার হাত থাকা অসম্ভব নয়।” সরকারি উদ্যোগে ভাল্ভ ব্যাঙ্ক তৈরি হলে তাদের মৌরসিপাট্টা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে তাই বাইরে থেকে বাধা আসছে বলে অভিযোগ স্বাস্থ্য ভবনেরই ওই অংশের। অভিযোগ মানতে নারাজ স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা। তাঁর কথায়, “যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরা আগে তা প্রমাণ করুন।” কৃত্রিম ভাল্ভ প্রস্তুতকারী কয়েকটি বহুজাতিক সংস্থার কর্তাদেরও বক্তব্য, “আমাদের এত ক্ষমতা নেই যে, সরকারি নীতি প্রণয়ন থামিয়ে দিতে পারি। তা হলে তো ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে কম টাকায় পেসমেকার বিক্রি করাও বন্ধ করে দেওয়া যেত।”
কেন চালু করা যাচ্ছে না ভাল্ভ ব্যাঙ্ক? আর জি করে যিনি প্রস্তাবটি তৈরি করেছিলেন, সেই কার্ডিওথোরাসিক সার্জন ভবতোষ বিশ্বাস জানান, প্রথম প্রস্তাবটি দেওয়ার পরে ব্যাঙ্কের জন্য হাসপাতালের তিন তলায় স্ত্রীরোগ বিভাগে জায়গা প্রস্তুত করা হয়। কাঁরা এই ব্যাঙ্কে কাজ করবেন, তা-ও মোটামুটি ঠিক করা হয়। ভাল্ভ রাখার জন্য আগের সরকার তিনটি ফ্রিজও দেয়। তার পরেই সব চুপচাপ! কিন্তু ব্যাঙ্ক চালাতে আর কী কী প্রয়োজন? ভবতোষবাবুর দাবি, ভাল্ভ সংরক্ষণ করতে ঘরের ভিতরে তরল নাইট্রোজেন সরবরাহের সংযোগ এবং ‘এয়ার ফ্লো’ ব্যবস্থা প্রয়োজন। দরকার মৃত্যুর পরে যে কোনও মেডিক্যাল কলেজে দান করা দেহ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাঙ্কে এনে তার থেকে ভাল্ভ তুলে নেওয়ার মতো ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা। এর কোনওটাই হয়নি। তাঁর অভিযোগ, “ব্যাঙ্ক চালু করতে স্বাস্থ্য, অর্থ ও পূর্ত দফতরে ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত আমি। তবু ফাইল নড়ে না! এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। এক জন ডাক্তারের এটা কাজ নয়। এ বার সরকার বুঝুক।” ভবতোষবাবুর অভিযোগ মানতেই রাজি নন স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তা। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “ভাল্ভ ব্যাঙ্ক খোলার জন্য ভবতোষবাবুকে সব রকম সাহায্য করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে কী কী প্রয়োজন, তা লিখিত ভাবে জানিয়ে সরকারি নিয়ম মতো ধাপে ধাপে এগোনোর মানসিকতা তাঁর নেই। এমনি এমনি তো আর সব হয়ে যাবে না।”
কলকাতা মেডিক্যালের প্রাক্তন সুপার ও কার্ডিওভাস্কুলার সার্জন সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী জানান, ২০০৮-’০৯ সালে তাঁদের হাসপাতালেও একটি ভাল্ভ ব্যাঙ্ক চালু করতে চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কোনও লাভ হয়নি। প্রায় দু’বছর পরে ফের উদ্যোগী হলেও সাড়া পাননি তিনি। দেহদান আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্রজ রায়ের কথায়, “প্রতি বছর রাজ্যে প্রায় ৫০০ দেহদান হয়। ব্যবস্থা থাকলে এই দেহগুলি থেকে ভাল্ভ সংগ্রহ করে তা প্রতিস্থাপন করা যেতেই পারে।”
বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সত্যজিৎ বসুর মতে, “ভাল্ভের প্রয়োজন মেটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার দৃষ্টিভঙ্গিই তৈরি হচ্ছে না। মৃতদেহ থেকে শুধু ভাল্ভ-ই নয়, হাড়-অস্থিমজ্জা-কার্টিলেজ-নার্ভ-মাংসপেশী-তন্তু-চোখ-চামড়ার মতো প্রায় সব কিছুই তুলে অন্য রোগীর দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু এত দিনে চক্ষু ব্যাঙ্ক এবং একটি মাত্র ত্বক ব্যাঙ্ক ছাড়া এ রাজ্যে অন্য কোনও অঙ্গ সংরক্ষণের ব্যাঙ্কই তৈরি হল না।” সত্যজিৎবাবুর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা ভারতে হৃদ্রোগ হুহু করে বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ হার্ট ভাল্ভ বিকল হওয়া। অথচ ভারতে প্রতি বছর যত ভাল্ভ প্রতিস্থাপনের দরকার, তার ১০ শতাংশও সম্ভব হয় না লোকের সামর্থ্য নেই বলে।” দিল্লিতে ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস’, মুম্বইয়ের একটি মিউনিসিপ্যাল হাসপাতাল ও চেন্নাইয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতাল ছাড়া ভারতের আর কোথাও মানুষের হার্ট ভাল্ভ-এর ব্যাঙ্ক নেই বলে জানান তিনি। |