|
|
|
|
নতুন মন্ত্র দিচ্ছে মন্ত্রণাসভা |
দাড়ি থেকে আস্তিন, শোধরাতে দশ দাওয়াই |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি |
এটা শাহরুখের সিনেমা নাকি! আজ ‘চক দে’-র কবীর, তো কাল ‘ম্যায় হুঁ না’-র রাম! আজ মুখে খোঁচা দাড়ি, কালই আবার ক্লিন শেভন! লোকে বলবে কী! ছেলেটা বিভ্রান্ত? নাকি মতি স্থির নেই!
যদিও তাঁর মুখের ওপর কিং খানের তুলনা দেওয়ার মুরোদ কারও নেই! তবে ১০ জনপথের কাছের নেতারাই এখন রাহুল গাঁধীকে স্পষ্ট জানাচ্ছেন, “এটা চলবে না চিফ (রাহুলের ওয়ার রুমে এ শব্দের চলন আছে)! হয় দাড়ি রাখুন, নইলে এক্কেবারে ছেঁটে ফেলুন।” কেন চলবে না? জয়রাম রমেশদের যুক্তি, লোকসভা ভোটের আবহে না চাইতেও যে মল্লযুদ্ধ শুরু হয়েছে তাঁর এবং নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে, তা বলতে পারেন ইদানীং কালের সব থেকে বড় রিয়েলিটি শো। মেগা সিরিয়াল বললেও মন্দ হয় না! সভায় গিয়ে পঞ্চাশ জন দেখলে টিভিতে চোখ রাখছেন পাঁচ লক্ষ। টানটান উত্তেজনায় ‘প্রাইম টাইম পারফরম্যান্স’ দেখছেন মানুষ। তাই দেখনদারিতে ধারাবাহিকতা চাই। নইলে নম্বর কাটা যাচ্ছে দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর!
এটুকুতেই শেষ নয়। রাহুলের ‘অন স্টেজ পারফরম্যান্স’ শোধরাতে তাঁর মেন্টররা দশ দফা দাওয়াইও দিয়েছেন। কে রয়েছেন সেই মেন্টর গ্রুপে? বলা ভাল, কে নেই! মা সনিয়া গাঁধী, বোন প্রিয়ঙ্কা বঢড়া, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ, সহযোগী কনিষ্ক সিংহ, বন্ধু দীপেন্দ্র হুডা ও দু’টি পেশাদার সংস্থা। তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, এ ছাড়াও আছেন আর এক জন। তিনি হতে পারেন শাহরুখ স্বয়ং। কারণ, দু’জনের মধ্যে মাঝেমধ্যেই কথা হচ্ছে!
কী বলছেন তাঁরা? |
|
রাহুল ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, হতে পারে মোদী ইতিহাসে কাঁচা, ভূগোলে গোল! কিন্তু নাটকে চোখ বুজে তাঁকে নব্বই দেওয়াই যায়। নইলে চ্যানেলগুলো শুধু তাঁকেই বা দেখাবে কেন? কারণ ওই ‘ড্রামাই’ টিআরপি আনছে। আর সেখানে টেনে টুনে পাশ করছেন রাহুল! হয়তো তিনি ভিতরে ভিতরে ঋজু। কিন্তু মুখের ভাবে নার্ভাস! জওহর ভবনে দলের ভিতরের বৈঠকে ফাটিয়ে দিচ্ছেন। অথচ খোলা মঞ্চে উঠলেই সব গুলিয়ে যাচ্ছে!
তা হলে কী করতে হবে তাঁকে?
গাঁধী পরিবার ঘনিষ্ঠ ওই নেতা বললেন, “তবে শুনুন! প্রথম পাঠ হল, কথায় কথায় কুর্তার হাতা গোটানো বন্ধ করতে হবে রাহুলকে।” বন্ধুদের কথায়, ওটা রাহুলের মুদ্রা দোষ। আসলে পোলো টি শার্ট পরতে ভালবাসেন রাহুল। তাই লম্বা হাতা হলে অস্বস্তি হয়। অনেক সময় এমনকী সংসদের মধ্যেও তাঁকে দেখা যায় হাতা গুটিয়ে বাইসেপ্সের ওপরে তুলে রেখেছেন। কিন্তু ওটা তো আর মঞ্চে চলে না। তা ছাড়া এ তো এলাকা দখলের লড়াই নয়! কংগ্রেসের অঘোষিত প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী তিনি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা হলে হাফ হাতা কুর্তা পরছেন না কেন! জবাবে টিম রাহুলের নেতাটি বলেন, “ওরেব্বাপ! ওতো মোদী পরেন। বিজেপি বলবে রাহুল নকল করছেন!”
তা না হয় হল। এ বার দ্বিতীয় পাঠ? কংগ্রেস নেতাটি জানালেন, তা হল, বক্তৃতার সময়ে কথায় কথায় ‘ভাইয়া’ বলা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ভাইয়া শব্দে খারাপটা কী? দীপেন্দ্র হুডার বক্তব্য, ভাইয়া শব্দে খারাপ বিশেষ নেই। তবে গঙ্গা-যমুনা তহজিবের দেশে ‘ভাইসাব’ বা শুধু ‘ভাই’ শুনতে ভাল লাগে। তা ছাড়া ‘ভাইয়া’ শব্দটি উত্তরপ্রদেশের অনেকেই সামন্ততান্ত্রিক বলে মনে করেন। যদিও সেটাও একমাত্র কারণ নয়। কংগ্রেস নেতাদের বক্তব্য, ভিড়ে কি শুধু ভাইয়ারা রয়েছেন? বহেনজিরা নেই? বাপ ঠাকুরদার বয়সী মানুষও তো শুনতে যাচ্ছেন। তাঁরা কী ভাববেন? অগত্যা, সেন্ট স্টিফেনসের প্রাক্তন ছাত্রকে এই যুক্তিও মানতে হয়েছে। |
|
করুন |
|
• আরও বেশি সময় ধরে বক্তৃতা দিন।
• বক্তৃতার সময় যথাসম্ভব আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করুন।
• মা, ঠাকুমা বা পরিবারের কথা যথাসম্ভব কম বলুন।
• দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে আগ্রাসন দেখান।
• জনতার সঙ্গে সওয়াল ও জবাবের মাধ্যমে ভিড়কে সভার সঙ্গে একাত্ম করে নিন। |
|
|
করবেন না |
|
•বক্তৃতার সময় কথায় কথায় ‘ভাইয়া’ বলা চলবে না।
•‘গুস্সা’ দেখানো চলবে না।
• বক্তৃতার সময় নোট দেখা বন্ধ করুন। যাতে মনে হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বক্তব্য রাখছেন।
• হয় দাড়ি রাখুন, নইলে একেবারে কেটে ফেলুন।
• বক্তৃতার সময় বারবার কুর্তার হাতা গোটানো বন্ধ করুন। |
|
|
|
|
রাহুলের জন্য এ সব পাঠ কিন্তু নতুন নয়। উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা ভোটের সময়েই একটি পেশাদার সংস্থা সেখানে সমীক্ষা করে তাঁকে বলেছিল, মানুষ মায়াবতীর ওপর বড্ড রেগে রয়েছে। তাই আপনাকেও গুস্সা দেখাতে হবে। ওটাও একটা কৌশল। ‘চড় গুন্ডোকি ছাতি পর’ ধরনের। কিন্তু সেই পেশাদার সংস্থাটিই এখন বলছে, এ বার ‘গুস্সা ছোড়িয়ে’। কেন? কারণ, মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি নিয়ে কংগ্রেসের ওপরেই রেগে রয়েছে মানুষ। তাই তারা উল্টো রাগ দেখালে পালানোর পথ পাওয়া যাবে না। সে জন্যই এ বার রাহুলকে পরামর্শ, গুস্সা একেবারেই নয়। বরং বিনয় দেখান। তবে হ্যাঁ, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন দেখাতে পারেন। দেখাতে পারেন গরিবি হটানো ও আমআদমি-র আর্থ সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্যও।
আরও একটা কথা বলছেন তাঁরা: আগ্রাসন স্বতঃস্ফূর্ত হওয়া চাই। এই যে সে দিন চুরুর সভায় রাহুল এক গোছা কাগজ নিয়ে মঞ্চে নাড়াচাড়া করছিলেন, তা চলবে না। তাতে মানুষ ভাববে, সব লিখে এনেছেন রাহুল। তাঁকে দেখাতে হবে, প্রস্তুতি ছাড়াই তিনি বক্তৃতা দিচ্ছেন। যা বলছেন তা একেবারে মন থেকে। আর বলা হয়েছে, “কথায় কথায় মা ঠাকুমার কথা তুলবেন না প্লিজ। পারিবারিক ঐতিহ্য ও ত্যাগের কথা মাঝে মাঝে বলুন। কিন্তু সব সময় নয়।” এই পারমর্শটি তাঁকে দিয়েছেন সনিয়া-প্রিয়ঙ্কাও। শোনা যাচ্ছে, সনিয়া তাঁকে বলেছেন, “আমার কথা ছেড়ে নিজের কথা বলো। আমার কথা না হয় আমিই বলব।”
ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলছেন, রাহুল কিন্তু ছাত্র খারাপ নন। কুর্তার হাতা গোটানো ছাড়তে হয়তো সময় লাগছে। কিন্তু বাকি অনেক কিছু শুধরে নিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশের হামিরপুরের সভায় তা চোখেও পড়েছে। দিল্লির গুরুদ্বারা রেকাবগঞ্জ রোডে বসে টিভিতে সেই বক্তৃতা দেখছিলেন টিম রাহুলের নেতারা। সভা শেষ হতেই টেক্সট মেসেজ গিয়েছে রাহুলের ফোনে: “ব্রেভো! কিপ ইট আপ!”
এ সব তো গেল ‘ডোন্টস’ বা না করা। ‘ডু ইট নাউ’ তা হলে কী?
কংগ্রেসের সহ-সভাপতির আস্থাভাজন মন্ত্রিসভার এক সদস্য বলেন, প্রথমেই হল, বক্তৃতার সময় বাড়ানো। মোদীর মতো ঘণ্টাখানেক যদি না-ও হয়, অন্তত দশ-পনেরো মিনিটে বক্তৃতা সেরে ফেলবেন না। দূর দূরান্ত থেকে যে লোকগুলোকে কংগ্রেস নিয়ে আসছে, তাঁরা তো হতাশ হচ্ছেন। তাই আরও একটু দীর্ঘ বক্তৃতা দিন। তার ফাঁকে ফাঁকে প্রশ্ন ছুড়ে দিন ভিড়ের দিকে। যে প্রশ্ন হবে চাঁচাছোলা, বিজেপি ও মোদী বিরোধী। সাধারণ মানুষ রোজকার জীবনে যে ভাষায় কথা বলেন, সেই ভাষা থাকবে বক্তৃতার মধ্যে, যাতে তা সহজে লোকের মনে গেঁথে যায়। সর্বোপরি কৌশলে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও একটু আধটু কথা বলার পরামর্শ দিচ্ছেন কংগ্রেস নেতারা।
সব বলে টলে কংগ্রেস নেতাটির প্রশ্ন, “কী বুঝলেন?” জবাব দেওয়ার আগেই টিম রাহুলের আর এক সদস্য বললেন, “বড্ড চাপে আছেন চিফ। সকালে উঠে সভা করতে ছোটো। দুপুরে বৈঠক, সন্ধ্যায় প্রার্থী বাছাই। তার ওপর রাজ্যওয়াড়ি অভাব-অভিযোগ শোনা তো আছেই।” তা হলে ‘স্ট্রেস’ কাটাচ্ছেন কী ভাবে? কংগ্রেসের নেতাটি হেসে বললেন, “শুনলে হাসবেন না তো! রাত দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ মাঝে মধ্যেই চলে যাচ্ছেন লোধী গার্ডেনে।” অত রাতে? কেন? “কেন আবার, ছুটতে!” |
|
|
|
|
|