শর্ট স্ট্রিটে হামলার তদন্তে বেশ বড়সড় মোড়! পুলিশ জানল, ১০ নভেম্বরের মধ্য রাত থেকে ১১ তারিখের সকাল পর্যন্ত ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে মোবাইলে কথা বলে গিয়েছেন বেশ কিছু লোকজন। অর্থাৎ, শর্ট স্ট্রিটের বাসিন্দা রতনলাল নাহাটার বাড়িতে বাউন্সারদের হামলা ও তার জেরে খুনোখুনির ঠিক আগে-পরে মোবাইলে চলেছে ওই কথোপকথন।
কারা তাঁরা?
পুলিশ জানাচ্ছে, এঁরা সবাই সম্পত্তি দখলের যড়যন্ত্রে জড়িত, শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের কুশীলব। ওই ঘটনায় এ পর্যন্ত যাঁদের ধরা গিয়েছে, কিংবা ধরা যায়নি, তাঁদের সকলের মোবাইলের ‘কল লিস্ট’ ঘেঁটে এমনটাই জেনেছেন তদন্তকারী অফিসারেরা। সেই ‘কল লিস্ট’-এ নাম আছে এক পুলিশ অফিসারেরও। তাঁর নাম নূর আলি। তিনি সংশ্লিষ্ট শেক্সপিয়র সরণির সিনিয়র সাব-ইনস্পেক্টর ছিলেন। ইতিমধ্যেই অবশ্য তাঁকে থানার ডিউটি থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। পুলিশ জানাচ্ছে, ঘটনার আগের রাতে নূরের সঙ্গেই ১৫ বার মোবাইলে কথা হয়েছিল ফারহান নামে এক যুবকের। ৯-এ শর্ট স্ট্রিটে আঁকড়ে বসে থাকা সম্পত্তির কারবারি রতনলাল নাহাটার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ওই ফারহান। থানার একটি সূত্রের দাবি, নাহাটার তরফে ওই যুবকই নূরের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ রাখতেন। ঘটনার পর থেকেই অবশ্য বেপাত্তা ফারহান।
ফারহানেরই ‘কল লিস্ট’ ঘেঁটে পুলিশ জেনেছে, ওই রাতে তাঁর সঙ্গে একাধিক বার কথা হয়েছে আইনজীবী পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও। ওই আইনজীবীই যে ১১ নভেম্বর ভোরে বাউন্সার নিয়ে শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে পুলিশ একরকম নিশ্চিত। বর্তমানে পার্থ পুলিশি হেফাজতে। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সম্পত্তি দখলের কাজে ওই আইনজীবীকে নিয়োগ করেছিলেন পিনাকেশ দত্ত নামে অন্য এক সম্পত্তির কারবারি। হামলার আগে রাতে তাঁর সঙ্গেও পার্থর একাধিক বার কথোপকথনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এবং সূত্র সেই কল লিস্ট। পিনাকেশকেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এক গোয়েন্দা-কর্তা বলেন, “হামলার সময় পিনাকেশ শর্ট স্ট্রিটে হাজির ছিলেন, সে কথা জানা গেলেও আইনজীবী পার্থর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা প্রথমে জানা যায়নি। মোবাইলের সূত্র ধরে জেরা করতেই পার্থ কবুল করেন, পিনাকেশই তাঁকে সম্পত্তি দলের বরাত দিয়েছিলেন।” পুলিশ বলছে, ওই রাতেই পিনাকেশের সঙ্গে একাধিক বার কথা হয়েছিল সম্পত্তির আর এক কারবারি পরাগ মজমুদারের সঙ্গেও। পুলিশের দাবি, জেরায় পিনাকেশ বলেছেন, শর্ট স্ট্রিটে সম্পত্তি দখলের জন্য পরাগই তাঁকে বরাত দিয়েছিলেন। বিনিময়ে মোটা টাকার প্রতিশ্রুতি ছিল। পিনাকেশের এই কথার সত্যতা খতিয়ে দেখতে শনিবার দুপুরেই ধৃত পরাগকে টানা জেরা করেন তদন্তকারী অফিসারেরা। জেরার সময় ধৃতের দুই আইনজীবীও হাজির ছিলেন। লালবাজার সূত্রের খবর, পিনাকেশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল, পরাগের কাছে তা জানতে চায় পুলিশ। ব্যবসার খাতিয়ে দু’জনে মধ্যে কত টাকার লেনদেন হয়েছিল- জানতে চাওয়া হয় তা-ও। পুলিশের দাবি, পিনাকেশের সঙ্গে টাকার লেনদেনের কথা অস্বীকার করেছেন পরাগ।
পুলিশ জানাচ্ছে, কল লিস্ট-এ নাম মিলেছে কৌশিক সেন নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতারও। হামলার রাতে পরাগ ও পিনাকেশের সঙ্গে কৌশিকেরও কথা হয়েছিল বলে পুলিশের দাবি। যদিও ওই তৃণমূল নেতা এ দিন যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “মাস দুয়েক আগে ওই জমির ব্যাপারে মমতা অগ্রবালের সঙ্গে আমার এক বার কথা হয়েছিল। কিন্তু তারপরে আর কারও সঙ্গে এ নিয়ে আমার কথা হয়নি। ঘটনার আগের রাতে আমার সঙ্গে পিনাকেশ ও পরাগের কথা হয়েছিল বলে যা জানানো হচ্ছে, তা পুরোপুরি মিথ্যে।” কৌশিকের পাল্টা অভিযোগ, সম্প্রতি তিনি কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। সেই জন্যই তাঁকে এই ঘটনায় জড়ানোর চেষ্টা চলছে। ওই রাতে আইনজীবী পার্থ কথা বলেছিলেন অরূপ দেবনাথের সঙ্গেও। অরূপের সংস্থা থেকে বাউন্সার নিয়েই শর্ট স্ট্রিটের জমি দখলের চেষ্টা হয়েছিল বলে পুলিশ জানাচ্ছে। কিন্তু ঘটনার পরের দিন থেকেই অরূপ পলাতক। পুলিশ জেনেছে, পার্থর সঙ্গে অরূপের আগে থেকেই আলাপ ছিল। অরূপ যে বাউন্সার জোগান দেন, এ বছর পুজোর মুখে সে কথা জানতে পারেন পার্থ। ফলে শর্ট স্ট্রিটে সম্পত্তি দখলের ছক চূড়ান্ত হতেই পার্থ যোগাযোগ করেন অরূপের সঙ্গে। পুলিশ বলছে, পিনাকেশের সঙ্গে পার্থর খুব বেশি দিনের আলাপ নয়। কিন্তু বাবার চিকিৎসার কারণে পার্থর অনেক টাকার দরকার, এ কথা জানতে পেরে মাসখানেক আগে পিনাকেশ তাঁকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা দেন। বিনিময়ে শর্ট স্ট্রিটের সম্পত্তি দখলের কাজে আইনি সহায়তা দিতে বলেন পার্থকে। পুলিশ জানাচ্ছে, বাউন্সার সরবরাহের জন্য অরূপকে আগাম ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন পার্থ। ওই টাকাটা পার্থকে দিয়েছিলেন পিনাকেশ।
এ দিন ওই পিনাকেশকে সঙ্গে নিয়েই বাঘা যতীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে তাঁর লকারে তল্লাশি চালায় পুলিশ। সেখানে ৮২ লক্ষ টাকা পাওয়া যায়। ওই টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, শর্ট স্ট্রিটের সম্পত্তি দখলের জন্য পরাগ মজমুদার গত এপ্রিলে হাওড়ার এক সম্পত্তির কারবারিকে দেড় কোটি টাকা দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় মুম্বইয়ের যে সংস্থার নাম জড়িয়েছে, তার অন্যতম কর্মকর্তা ওই ব্যক্তি। তিনি-ই পিনাকেশকে কাজ হাসিলের জন্য অগ্রিম দেড় কোটি টাকা দিয়ে রেখেছিলেন বলে পুলিশের দাবি। তাদের বক্তব্য, ওই টাকারই কিছুটা পিনাকেশ বাঘা যতীনের ব্যাঙ্কে রেখেছিলেন। এখনও বাকি টাকার খোঁজ চলছে।
এর পাশাপাশি শর্ট স্ট্রিটের ওই সম্পত্তি বেশ ক’বার কেনাবেচা করার অভিযোগ যাঁর দিকে, সেই রতনলাল নাহাটাকে এ দিন ফের সকালে ভর্তি করা হয়েছে পূর্ব কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে। পুলিশ জানায়, শুক্রবার রাতে ৯-এ শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে তদন্তকারী অফিসারেরা নাহাটার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কথা বলার মতো শারীরিক অবস্থা নেই তাঁর।
তবে এই ঘটনায় জড়িতদের সঙ্গে যে শেক্সপিয়র থানার অনেকেরই ঘনিষ্ঠতা ছিল, তা মেনে নিয়েছেন কলকাতা পুলিশের একাধিক কর্তা। লালবাজারের এক কর্তা বলেন, “হামলার কথা যে নূর আলির অজানা ছিল না, তা পরাগ ও পিনাকেশকে জেরা করে জানা গিয়েছে। তারপরেই নূরের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” ওই পুলিশকর্তা জানান, নূর আলি ছাড়াও আরও কয়েক জন অফিসারের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে মামলা রুজু করা হবে তাঁদের বিরুদ্ধে।
তদন্তকারী অফিসারদের একাংশ বলছেন, সাধারণ ভাবে ভোর সাড়ে ৩টের পরে গাড়ি নিয়ে থানার সাব-ইনস্পেক্টররা টহলদারিতে বেরোন। কিন্তু ১১ নভেম্বর শেক্সপিয়র সরণি থানার কোনও সাব-ইনস্পেক্টর ওই সময় টহলদারিতে বেরোননি। বেরিয়েছিলেন এক এএসআই, তা-ও মোটরসাইকেলে চেপে। কার নির্দেশে রাতের ডিউটিতে থাকা এসআই থানা থেকে বেরোলেন না, সেটাও লালবাজারের কর্তারা তদন্ত করে দেখছেন।
খোদ পুলিশ কমিশনারের বাড়ির গা ঘেঁষে ওই ধরনের হামলা কী ভাবে ঘটল, সেটাই এখন খোঁজার চেষ্টা করছে লালবাজার। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, “ওই বাড়ির ভিতর থেকে আমরা ন’টি গুলির খোল উদ্ধার করেছি। এর মধ্যে পাঁচটি দোনলা বন্দুকের, চারটি একনলা স্পোর্টিং গান-এর গুলি। ধৃত মমতা অগ্রবাল, পাপ্পু ও প্রমোদকে জেরা করে জানার চেষ্টা হচ্ছে, কে ক’রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল।”
|