বিনোদন ভূতের ঠেলায় প্রত্যাশার
পাহাড়ে আশ্চর্য প্রদীপ

ভূতে ভাগ্য খুলে দিয়েছিল তাঁর! দৈত্য কত দূর পয়া হবে?
প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে কলকাতা তথা বাংলার প্রথম শীতের বাতাসে। প্রশ্নের ধাক্কায় চিত্রপরিচালক অনীক দত্তের শরীরী ভাষাও পাল্টে যাচ্ছে। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর প্রিমিয়ারে নিজের ছবির কথা বলার সময়ে অনীকের গলার স্বর খানিকটা টেনশনে কাবু। হবে না-ই বা কেন! ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তো স্রষ্টা স্বয়ং। যাঁকে লড়তে হচ্ছে নিজের আগের (এবং ঘটনাচক্রে প্রথম) ছবি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর সঙ্গেও। শুক্রবার প্রিমিয়ারে ভিড় দেখে অনীক বলেই ফেললেন, “আমার প্রথম ছবি নিয়ে প্রত্যাশার এমন চাপ ছিল না।”
‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ যখন মুক্তি পায়, তখন গোড়ায় অনেকে ছবিটাকে খেয়ালই করেননি। সে-ভাবে প্রচার হয়নি। শুরুতে মাল্টিপ্লেক্সে ঠাঁইও হয়নি। প্রথমে দুপুরের শোয়ের পরে আস্তে আস্তে সন্ধের প্রাইম টাইমে স্লট মিলেছে। পরে সেই ছবি দেখে দর্শকেরা অনেকেই মুগ্ধ হয়ে ফের হলমুখো হয়েছেন। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঠিক উল্টো। শুরুতেই মাল্টিপ্লেক্সে একাধিক শো। তার মধ্যে সান্ধ্য শো-ও রয়েছে। ‘ভূত’কে শুরু করতে হয়েছিল শূন্য থেকে! আর প্রদীপের দৈত্য কি না জন্মের আগে থেকেই ‘ভূতের’ সাফল্যের দৌড়ে নেমে পড়েছে! অনীকের দ্বিতীয় ছবির পোস্টার পড়ার পর থেকেই বহু শহরবাসী বলতে শুরু করেছিলেন, “এই ছবিটা দেখতে হবে।” আর এখন ছবি মুক্তির এক দিনের মাথাতেই অনেককে দেখা যাচ্ছে চেনা-পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করতে “দেখলেন? কেমন?”
কিন্তু ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ঘিরে এই প্রত্যাশার পাহাড়টা কেন?
কেউ কেউ বলছেন, ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ঘিরে এই যে কৌতূহলের হাওয়াটা উঠেছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন জেমস বন্ডের নতুন ছবি মুক্তি পেল। এ বার কোন দেশে অভিযান, নতুন কী গাড়ি, নতুন কী গ্যাজেট, ‘বন্ড গার্ল’টিই বা কেমন— নানা কৌতূহল। টিম অনীকের চাপটা এখানেই! ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর শেষ দৃশ্য থেকেই সরাসরি ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর প্রথম দৃশ্যে ঢুকে পড়তে চাইছে দর্শককুল!
অনেকেই হয়তো জানেন না, ঠিক সময়ে প্রযোজক মিললে প্রদীপের দৈত্যর জন্মানোর কথা ছিল ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর আগেই! অনীক বলছিলেন, “শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চেনা গল্পের ভিত্তিতে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর চিত্রনাট্য আমি আগেই সাজিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর আইডিয়াটাই আগে প্রযোজকের মনে ধরল। আর আমি ওটার চিত্রনাট্যে হাত দিলাম।” অনীক স্বীকার করছেন, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর ছায়া দূরে সরিয়ে রাখতেই ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর চিত্রনাট্যে তিনি কিছু মেরামতিতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর দর্শকেরা কেউ কেউ বলছেন, অনীকের প্রথম ছবির ছায়া যে দ্বিতীয় ছবিতে একেবারে নেই, এমন নয়। বরং সেটা কোথাও কোথাও ‘আশ্চর্য প্রদীপ’কে একটা নতুন অ্যাডভান্টেজও দিচ্ছে। এবং তাঁদের মতে, অনীক নির্ঘাৎ সেটা জানেন। বিজ্ঞাপনের জগতে কয়েক দশক ধরে রগড়ানো, পেশাদার অনীক নিজের সুনামের এই শক্তিটুকু বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নতুন ছবিতে ব্যবহারও করেছেন।
কী ভাবে? ছবি দেখে বেরিয়ে তরুণ কর্পোরেট সৈকত গুপ্ত বলছিলেন, “আগের ছবিতে কলকাতার পুরনো বাড়ির বিপন্নতার গল্পের পরেই ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এ সাবেক কিউরিওশপে ফাস্টফুড আউটলেট বসানোর তোড়জোড়! দেখে মজা পাচ্ছিলাম! মনে হয়, পরিচালক সচেতন ভাবেই এই জায়গাটা রেখেছেন। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’কে অতিক্রম করে যেতে চাইলেও এটা যে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পরিচালকেরই ছবি, তা দর্শককে মনে করাতেও তিনি দ্বিধা করেননি।” অনীক অবশ্য মিলটা সরাসরি মানতে চাইলেন না। বললেন, “আমি যে সময়ের মানুষ, সেই সময়ের একটা ছাপ তো যে ভাবে হোক, থাকবেই! কলকাতার অতীত নিয়ে হ্যাংওভার, শহরটার নিজস্বতা হারানোর বেদনা, আবার কনজিউমারিজমের ছায়ার মতো কয়েকটি দিক তো ঘুরে-ফিরে ছবিতে আসবেই। অন্তত যত ক্ষণ না আমি পুরোদস্তুর কোনও পিরিয়ড ফিল্ম বানাচ্ছি।”
‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর সাফল্যের কিছু তুকতাক আশ্চর্য প্রদীপেও বিলক্ষণ দেখা যাচ্ছে! চোখা চোখা সংলাপে ছন্দের ব্যবহার, শব্দ নিয়ে খেলার অভাব নেই। শনি-সন্ধ্যায় হল থেকে বেরিয়ে হেসে খুন বেহালার আইনজীবী প্রিয়ম্বদা রায় থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সুরশ্রী কুণ্ডু। সুরশ্রী বলছিলেন, “শুরুর দিকেই পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়-মনোজ মিত্রদের সিনটা বেড়ে ছিল! আর ‘আইটি’র সঙ্গে ‘ভাইটি’ মিলিয়ে ওই ডায়ালগ তো দারুণ! এ ধরনের রসিকতা ‘হীরক রাজার দেশে’তেও ছিল!” সপ্তাহান্তের ভরপুর প্রেক্ষাগৃহ এমন সংলাপে বারবারই হেসেছে, হাততালি দিয়েছে। ফলে মাল্টিপ্লেক্স কর্তাদের হাসিটাও চওড়া হচ্ছে। আইনক্সের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, “খুব ভাল ওপেনিং স্পেল! শুধু কলকাতা নয়, বর্ধমান-দুর্গাপুরেও শতকরা ৯০ ভাগ আসন ভর্তি থাকছে।”
এখানেই সেই প্রশ্ন, শুরুতেই এই ঝোড়ো ব্যাটিংটা কতটা প্রদীপের নিজের জোরে, আর কতটা ‘ভূতের’ কারসাজি? এখানেই একটা ছোট্ট হার্ডলের আভাস। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর অন্যতম জোরদার অস্ত্র ছিল সংলাপ। শব্দের খেলা। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর দর্শকদের একটা অংশ কিন্তু এই ছবির সংলাপ নিয়েই কিছুটা সমালোচনার মুডে। তাঁরা বলছেন, টিভি-র কমেডি শোয়ের আদলে শব্দের অনুপ্রাস, দ্ব্যর্থকের ‘ডোজ’টা এ বার কিঞ্চিৎ বেশি হয়ে গিয়েছে। মজাটা আর একটু মাপা হলেই বরং বেশি হাসি পেত। অনীক অবশ্য জোর গলায় বলছেন, এটা মোটেও ‘ভূতের ভবিষ্যৎ স্টাইল’ নয়। বলছেন, “আশ্চর্য প্রদীপের গল্পের যা বিষয়, তাতে জীবনের কিছু অন্ধকার দিক ঢুকে পড়াটাও অনিবার্য ছিল। সাধারণ দর্শকের যেমনই মনে হোক, এই জায়গাটায় আমি আপস করতে চাইনি।” কিন্তু শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প থেকেও তো কয়েকটা জায়গায় সরে এসেছেন অনীক। খোদ শীর্ষেন্দুবাবু তাতে অবশ্য বিচলিত নন। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেওছেন, ছবি ও সাহিত্যের ভাষা আলাদা, তাই এমন অমিলটাই স্বাভাবিক। অনীক লেখককে তাঁর বাড়ি গিয়ে বলেছিলেন, চিত্রনাট্যের ক্লাইম্যাক্স তিনি পাল্টে ফেলেছেন। লেখক তাঁকে সহাস্য প্রশ্রয় দেন। অনীকের কথায়, “স্বপ্ন-বাস্তবের মধ্যে সম্পর্কের একটা জায়গা দু’টো ছবির স্ক্রিপ্টেই ছিল। ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এ ওই জায়গাটা আমি একটু আলাদা করতে চাইছিলাম। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর মতো রাখতে চাইনি।”
অনীককে ভরসা দিচ্ছেন এই সময়ের অন্যতম শক্তিশালী পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ছবির শেষটা দিব্যি হয়েছে— শংসাপত্র দিচ্ছেন তিনি। জিনের (রজতাভ দত্ত) পাল্লায় পড়ে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের ভোলবদল বা ‘মেকওভার সিন’-এর গানটাও কৌশিক চেটেপুটে উপভোগ করেছেন। ছবির ক্লাইম্যাক্স প্রসঙ্গে কৌশিক বলছেন, “অনীকের রসবোধ, বুদ্ধির ছাপ তো নতুন নয়! তবু এই ছবির শেষটা সত্যি গভীর! অনীকের এমন মননের স্বাদ পেয়েই ওঁর পরের ছবির জন্য আমার খিদে বাড়ছে।” এখন দেখার, আম-বাঙালির ভাল ছবি দেখার খিদেটা কত দূর উস্কে দিতে পারে অনীকের ‘আশ্চর্য প্রদীপ’!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.