বছরটা বড়ই মঙ্গলময়! লাল গ্রহে দারুণ ভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন ‘মিস কৌতূহল’ কিউরিওসিটি রোভার, সফল হল ভারতের মঙ্গলযান উৎক্ষেপণ, আর তার দু’সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই সোমবার মঙ্গলে পাড়ি দেবে নাসারই কৃত্রিম উপগ্রহ মাভেন (মার্স অ্যাটমোসফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল ইভলিউশন)।
নাসা জানিয়েছে, কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। কেপ ক্যানাভেরালে তোড়জোড় চলছে পুরোদমে। সব কিছু ঠিক থাকলে ১৮ নভেম্বর, সোমবার অ্যাটলাস-৫ এ চেপে মঙ্গলে পাড়ি দেবে মাভেন।
‘মিশন মাভেন’-এর পুরোভাগে রয়েছেন কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোবায়োলজির অধ্যাপক ব্রুস জ্যাকোস্কি। জানালেন, মঙ্গল গ্রহকে ঘিরে রয়েছে বাতাসের একটা পাতলা পর্দা। এক সময় মঙ্গলেও পৃথিবীর মতোই বায়ুমণ্ডল ছিল। ওই হালকা বায়ুস্তরই তার ইঙ্গিত দেয়। কী ভাবে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে লাল গ্রহের বায়ুমণ্ডল, ফেলে গিয়েছে একটা পাতলা হাওয়ার চাদর সেই রহস্য ভেদ করতেই মাভেনের মঙ্গল পাড়ি। আর তার সঙ্গে সে খতিয়ে দেখবে গ্রহের হারিয়ে যাওয়া জলস্তরের রহস্যও। যদিও বায়ুমণ্ডল কি জলস্তরের অস্তিত্ব, রহস্যের বীজ লুকিয়ে রয়েছে এক জায়গাতেই? কিউরিওসিটি-র মতো মঙ্গলের মাটিতে পা ফেলবে না মাভেন। বরং কক্ষপথ থেকেই নজর রাখবে। ঠিক যেমনটা করবে ইসরোর মঙ্গলযান। |
ব্রুসের মঙ্গল-যজ্ঞ কিন্তু শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই ২০০৮ সালে। ব্রুস তাঁর পরিকল্পনার কথা জানাতে, সে বছরই সবুজ সঙ্কেত দেখায় নাসা। ৪৮ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার ব্যয়ে তৈরি মহাকাশযানটি এখন কেপ ক্যানাভেরালে পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়ার অপেক্ষায়। দশ মাস লাগবে মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছতে। আর তার পরই শুরু হবে গবেষণা। সেপ্টেম্বর মাসে ওই একই সময়ে লাল গ্রহে পৌঁছবে ভারতের মঙ্গলযানও। নাসা কিউরিওসিটি রোভার পাঠিয়েছে মঙ্গলে। লাল গ্রহের কক্ষপথে ঘুরে নজর রাখছে নাসারই ‘মার্স ওডিসি’ এবং ‘মার্স রিকনিস্যান্স’। প্রথমটিকে পাঠানো হয়েছিল ২০০১ সালে, দ্বিতীয়টিকে ২০০৫-এ। ইসরোও ‘মঙ্গলযান’ পাঠাল। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইএসএ) ‘মার্স এক্সপ্রেস’ও ঘুরছে মঙ্গলের কক্ষপথে। সেই ২০০৭ সাল থেকে। তা হলে আবার মাভেন-অভিযান কেন? কেনই বা মঙ্গলের চারপাশে এত কড়া পাহারা?
সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন নাসার মঙ্গল অভিযান দলের অন্যতম শীর্ষবিজ্ঞানী অমিতাভ ঘোষ। কিউরিওসিটির পর এ বার তিনি মাভেন অভিযানেও রয়েছেন। ফোনে জানালেন, নাসার প্রত্যেকটি মহাকাশযানের কাজ আলাদা আলাদা। আর তা ছাড়া বাকিরাও একে অপরকে সাহায্য করছে সব সময়। উদাহরণস্বরূপ, মঙ্গলের কক্ষপথ উপবৃত্তাকার। ইএসএ-র মার্স এক্সপ্রেস যখন ঘুরতে ঘুরতে মঙ্গলের কাছাকাছি চলে আসবে, তখন সে ভাল করে নজর রাখবে গ্রহের গতিবিধির উপর। আবার মাভেন যখন কাছে আসবে, তখন দায়িত্ব তার। |
মঙ্গলের পথে |
• মার্স অ্যাটমোসফিয়ার অ্যান্ড ভোলাটাইল ইভলিউশন, সংক্ষেপে মাভেন
• যাত্রা শুরু: ১৮ নভেম্বর, অ্যাটলাস-৫ চেপে
• পৌঁছতে: দশ মাস
• তদন্তের বিষয়: কী ভাবে হারিয়ে গেল মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল |
|
মাভেনের কাজ সম্পর্কে তিনি আরও খোলসা করে জানালেন। বললেন, “এত দিন লাল গ্রহ সম্পর্কে যা যা তথ্য হাতে এসেছে, তাতে এটা স্পষ্ট, যে মঙ্গলে এক সময় প্রভূত পরিমাণ জল ছিল। মঙ্গলের মাটিতে শূন্য নদীখাতের ছবি-ই তার প্রমাণ দেয়। এই জলরাশিকে বাঁচিয়ে রাখতে দরকার ছিল বায়ুমণ্ডল। কারণ বায়ুস্তরই বজায় রাখত গ্রহের প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা।” উদাহরণ দিতে গিয়ে বললেন, “গাড়ির জানলার কাচ যদি তুলে দেওয়া হয়, গাড়ির ভিতরটা গরম হয়ে যায়। কারণ সূর্যের আলো ভিতরে ঢুকতে পারে, কিন্তু বেরোতে পারে না। ঠিক সে রকম, মঙ্গলে যখন বায়ুমণ্ডল ছিল, সূর্যালোক ভিতরে ঢুকে গ্রহকে গরম রাখত। ফলে জলের অস্তিত্ব ছিল।” কিন্তু কোটি কোটি বছর আগে কোনও এক রহস্যময় কারণে হারিয়ে গিয়েছে বায়ুমণ্ডল। মঙ্গলে এখনও যে বায়ুস্তর রয়েছে, তাতেও কিন্তু ক্ষয় থেমে নেই। এখনকার বায়ুস্তর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ১০০ ভাগের ১ ভাগ। গবেষক মহলে এমনও ধারণা রয়েছে, ৪০০ কোটি বছর আগে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে লাল গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র হঠাৎ তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে মঙ্গলের টান হারিয়ে মহাকাশে হারিয়ে গিয়েছিল হাওয়ার চাদর। বিষয়টিকে পরমাণু স্তরে খতিয়ে দেখতে সাহায্য করবে মাভেনের ‘আলট্রা ভায়োলেট স্পেকট্রোগ্রাফ’ নামের যন্ত্রটি। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে রয়েছে প্রভূত পরিমাণ ডয়টেরিয়াম (ভারী হাইড্রোজেন)। হালকা হাইড্রোজেন পরমাণুর মতো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা এর নেই। গ্রহের পাথরে হাইড্রোজেন ও ডয়টেরিয়ামের অনুপাতের সঙ্গে বাতাসে এদের উপস্থিতি তুলনা করেও বায়ুমণ্ডলের ক্ষয়ের কারণ খুঁজে দেখা হবে।
কিন্তু মঙ্গলের জল-হাওয়া নিয়ে যে এত কথা হচ্ছে, তা বিজ্ঞানীরা জানলেন কী করে? অমিতাভবাবু জানালেন, কিউরিওসিটির পাঠানো ছবিতেই ধরা পড়েছে মঙ্গলে ধুলোর ঝড়। তা ছাড়াও রোভার অপরচুনিটি-ও প্রমাণটা দিয়েছিল। অপরচুনিটিতে সৌর প্যানেল আছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, এর সৌর প্যানেলে ধুলোর আস্তরণ পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলে পৌঁছনোর পরে দেখা যায় সেই ধুলোর স্তর আর নেই। একমাত্র হাওয়া থাকলেই এটা হওয়া সম্ভব।
কথায় কথায় অমিতাভবাবু এ-ও বললেন, “পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকেও প্রতি মুহূর্তে কিছু পরিমাণ অণু-পরমাণু মহাকাশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সেটা অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।” তা হলে কি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও হঠাৎ করে হারিয়ে যাবে? এত গবেষণার পিছনে কি পৃথিবীর আপন প্রাণ বাঁচানোর চিন্তাই রয়েছে বিজ্ঞানীদের মাথায়? অমিতাভবাবু জবাব ‘না’। তিনি বললেন, “সুদূর ভবিষ্যতে বিষয়টা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা হতে পারে।”
মাভেনের পর নাসার পরবর্তী যান রওনা দেবে ২০২০ সালে। নাসা জানিয়েছে, তাদের মাভেন ছাড়া বাকি যানগুলি অকেজো হয়ে গেলে কিউরিওসিটিকে সাহায্য করা থেকে নাসার মিশন কন্ট্রোল রুমে খবর পাঠানো একমাত্র ভরসা মাভেন-ই। ভারতের মঙ্গলযানের সঙ্গেও কি তথ্য আদানপ্রদান করবে মাভেন? অমিতাভবাবু হেসে বললেন, “সেটা মঙ্গলে পৌঁছনোর পরই ঠিক করবে নাসা।” |