|
|
|
|
স্মরণ ২ |
পিতামহ ভীষ্ম |
আধুনিক গানের। সলিল চৌধুরী। জন্মদিনের আগে গুরুপ্রণাম দেবজ্যোতি মিশ্রের। |
চিহ্নগুলো তাঁর স্পষ্ট। সুন্দর। তীব্র।
ভারতের আধুনিক গানের পিতামহ ভীষ্ম তিনি।
বিশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে এই প্রবল প্রখর ভীষ্মকে প্রথম বার দেখি বিদ্যামন্দিরের মঞ্চে।
আমি তখন আঠেরো। ‘প্রতিধ্বনি’ নামের একটি কয়্যার গ্রুপ বড় ভালবেসে পরিবেশন করত সলিল চৌধুরীর গান। আমি ছিলাম ওই গ্রুপের বেহালা-বাজিয়ে। এমনই একটি অনুষ্ঠানে... এমনই অকস্মাৎ!
যিনি আমার ইষ্ট, তাঁকে এত কাছ থেকে দেখার আবেগে যেন থমকে গিয়েছিল শরীরের রক্ত চলাচল।
তিনি বললেন, আমার সঙ্গে এসো। ভারী মজার গানবাজনা হবে।
সেই ঘর ছাড়লাম। পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে।
একবার কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছি সলিলদার সঙ্গে। আমাকে বসিয়ে সলিলদা গিয়েছেন সুচিত্রা মিত্রের বাড়িতে। সুভাষদা আমার সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। জানতে চাইলেন সলিলদার হালফিলের কাজকম্মের কথা। বললেন, আমি চাই আমার লেখা নিয়ে আরও কিছু গান করুক ও।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অগ্নিকোণের তল্লাট জুড়ে’ কবিতাটি বড় জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সলিলদার সুরে। সুভাষদা বলছিলেন, আমরা তো অনেক রঙিন বিপ্লবের কবিতা লিখেছি। কিন্তু ‘শপথ’ লিখে সলিল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কত বড় মাপের কবি... ‘সেদিন রাত্রে সারা কাকদ্বীপে হরতাল হয়েছিল’। |
|
সলিলদা আর হেমন্তদার জুটি তখন ইতিহাস। আমার মনে পড়ছে আশির দশকের গোড়ার দিকের একটি ঘটনা। রবীন্দ্রসদনের এক অনুষ্ঠানে সলিলদা আর হেমন্তদা মুখোমুখি। তাঁদের মধ্যে তখন জমেছে অভিমানের মেঘ। কিছু মানুষ থাকেন না, যাঁরা অনর্থক ভাঙন ধরাতে চান দুই শিল্পীর গাঁটছড়ায়! সেভাবেই কেউ কেউ চেষ্টা করেছিলেন এই যুগলবন্দিকে বিভ্রান্ত করতে। বহু দিন সলিলদার সুরে গান করতেন না হেমন্তদা।
ওঁকে দেখামাত্র এক গভীর আর্তি বেরিয়ে এল সলিলদার গলা থেকে, ‘হেমন্তদা....।’
দু’জনে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনকে। দুজনেরই চোখে জল। কুশল বিনিময়ের পর হেমন্তদা বললেন, চল সলিল, আমরা আবার কিছু গান করি।
ফার্ন রোডের অফিসে সকাল সকাল চলে আসতেন সলিলদা। তাঁর নিজস্ব কাজকর্ম গুছিয়ে নিতেন সেখানে। মূল বাজার থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সব্জিওয়ালারা হালকা হতে হতে সলিলদার অফিস অবধি চলে আসত।
একদিন তাঁদের মধ্যে তুমুল বচসা শেষ পর্যন্ত হাতাহাতির চেহারা নিল। দা-য়ের কোপে রক্তাক্ত ছেলেকে নিয়ে বুড়ি মা এসে হাজির সলিলদার কাছে। তাঁরা জানেনও না সলিল চৌধুরীর পরিচয়। শুধু জানেন এই মানুষটাই তাঁদের এক ভরসাস্থল।
সলিলদা তাঁদের নিয়ে সেই মুহূর্তেই পিজি হসপিটাল। সামলে দিলেন চিকিৎসার দায়দায়িত্ব। অভিভাবকের মতো। তখন কিন্তু বয়ে চলেছে স্টুডিয়োতে রেকডির্ংয়ের সময়।
সলিলদারই একটা অনুষ্ঠানে আমি সত্যজিৎ রায়-কে নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছি। শ্যুটিংয়ের কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি জানালেন, হয়তো যাওয়া হয়ে উঠবে না তাঁর। তবে তার সঙ্গে এ কথাও বললেন, সলিলবাবু যদি নিজের গলায় সেই অনুষ্ঠানে ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’ গানটা গান, তবে চলেই আসবেন। পুরো বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম বিশফ লেফ্রয় রোডের বাড়ি থেকে।
একটু পিছিয়ে যাই। ‘সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়’। এমনই ছিল সলিল চৌধুরীর তখনকার মুম্বই যাত্রা। ক্লান্ত, শ্রান্ত, স্বপ্নভঙ্গ। যে বামপন্থী আন্দোলনের হাত ধরে আসা তাই-ই তখন ব্যক্তি মানুষটিকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এমন অবস্থায় সলিলদার ‘রিকশাওয়ালা’ গল্প অবলম্বনে ছবি তৈরি করবেন বিমল রায়। ডাক পড়ল। বন্ধু হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বিমল রায়কে বললেন, সলিল তো মূলত গান-বাজনারই। ওকেই যদি ‘দো বিঘা জমিন’-এর সঙ্গীতের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুরু হল সলিল চৌধুরীর নতুন যাত্রা।
আবার ‘মধুমতী’র সময় ঘটল অন্য ঘটনা। গান হয়ে গিয়েছে। পিকচারাইজেশনের কাজ শেষ। ছবির টেকনিশিয়ান ও বিশিষ্ট কিছু মানুষের জন্য স্পেশাল স্ক্রিনিং হচ্ছে।
তখনই এগিয়ে এলেন শচীন দেব বর্মন। যাঁকে বলে গুরুর গুরু। বিমল রায়কে ডেকে বললেন, সলিলের এই গানগুলান ইতিহাস হইব, দেইখ্যা রাখেন। বিমল রায় খানিকটা আশ্বস্ত হলেন শচীন কর্তার কথায়। তার পরের ঘটনা তো সকলের জানা। এখনকার ভাষায়, সুপারডুপার হিট হয় ‘মধুমতী’র গান।
বিভিন্ন সময়ে স্ট্রাগলের কথা বলতে গিয়ে এমন অনেক কথা বলতেন সলিলদা।
সলিলদার প্রিয় সুরকার ছিলেন শচীনদেব বর্মন। তার সঙ্গে আর ডি বর্মনেরও অসম্ভব গুণগ্রাহী ছিলেন তিনি। প্রায়ই বলতেন, পঞ্চম একটা জিনিয়াস।
কত বার শচীনকর্তা রাহুলদেবের সঙ্গীতের ব্যাপারে বিচলিত হয়ে বলেছেন, পঞ্চম কী সব করতাসে! ও হইল গিয়া আমার পোলা। তুমার চ্যালা। অরে একটু বুঝাও। সলিলদা হেসে আশ্বস্ত করতেন।
হেমন্ত-মুকেশ-রফি-মান্নার পাশে সলিলদার সুরে কিশোরকুমারের গান খুব কমই ছিল। সলিলদার কাছেই শোনা, এ নিয়ে কিশোরকুমারের একটা অভিমান ছিল।
অথচ ‘অন্নদাতা’র ‘গুজর যায়ে দিন’ গান শুনে আমরা মিউজিশিয়ানরা বারবার মুগ্ধ হই। কিংবা ‘মেরে আপনে’ ছবির ‘কোই হোতা জিসিকে আপনে’র ওই অপূর্ব মেলোডিয়াস সুর আর তার সুবিশাল রেঞ্জ লক্ষ লক্ষ বার শুনেও বুঝতে পারি না কিশোরকুমার ছাড়া আর কোনও শিল্পী এই গান গাইতে পারতেন কি না। অথচ সেই কিশোরকুমারকে কেন অত কম গাওয়ালেন তিনি!
জিজ্ঞেস করলে সলিলদা বলতেন, কিশোরকুমার নাকি তখন এত ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁকে স্টুডিয়োয় হাজির করে রিহার্সাল দেওয়ানো মুশকিল ছিল। যদিও শুনেছি, কিশোরকুমার না কি মুখিয়ে থাকতেন সলিলদার গান গাওয়ার জন্য।
সলিলদার সঙ্গে জুড়ে ছিল নানা খামখেয়ালিপনার গল্পও। একবার পার্ক সার্কাস থেকে থলেভরতি বাজার করেছেন। আমাকে নিয়ে চলে গেলেন সটান শম্ভু মিত্রের বাড়ি।
পার্ক সার্কাসের বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল জলদগম্ভীর জিজ্ঞাসা কী সলিল, তুমি হঠাৎ? মাস ছ’য়েক আগে সেই যে বলে গেলে বাজার করে ফিরবে, তার পর তো আর দেখাই নেই। সলিলদা সহাস্যে বাজারের থলি দেখিয়ে বললেন, এই তো ফিরেছি। সুরসিক শম্ভু মিত্রের প্রতিক্রিয়া তুমি আসলে টগবগে ঘোড়া। তোমার সঙ্গে পেরে ওঠাই মুশকিল!
সত্যিই একটা টগবগে প্রাণ ছিল সলিলদার। কলকাতাকে নিয়ে একবার সিম্ফোনি তৈরি করার কথা ভেবেছিলেন।
অনেকটা কম্পোজিশন হয়েও গিয়েছিল। কন্যা অন্তরা তার কী-বোর্ডে অনেকটা প্রোগ্রামিংও সেরে ফেলেছিল। শেষমেশ সলিলদার সে কাজে হাত দেওয়া হয়ে উঠল না।
তখন কে জানত সলিলদা অমন সাততাড়াতাড়ি চলে যাবেন! |
|
|
|
|
|