মুখোমুখি...
নাট্যজগতের গুজগুজ ফুসফুস ভাল লাগে না

পত্রিকা: রেশমী, বাইরে যতই গুডি গুডি ইমেজ ধরে রাখুক, স্বামী হিসেবে কৌশিক কি খুব দাপুটে? কেন জিজ্ঞেস করছি, বলি। আপনি সেই শুরু থেকে ‘স্বপ্নসন্ধানী’-তে আছেন। অথচ মঞ্চে উঠেছেন বহু দেরিতে। কাঞ্চন (মল্লিক) আপনার পরে এসেও বড় চরিত্র করেছেন। মহিলাদের বড় রোল মানেই এক সময় করতেন দিতিপ্রিয়া (সরকার)। কৌশিক কি চাননি আপনি কাজ করুন?
রেশমী: সত্যি বলছি, কৌশিক গুডি গুডি ইমেজ শুধু দেখায়ই না, ও সত্যিই গুড বয়। কিন্তু হ্যাঁ, আমার থিয়েটার করার ব্যাপারে ওর রিজারভেশন ছিল। বোধহয় মনে করত, আমি অভিনয় ঠিক জানি না। আর একটা সঙ্কোচ ছিল, লোকে যেন না বলে, ডিরেক্টর বলেই বৌকে চান্স দিল! এই সব মিলিয়ে ও অনেক দিন অবধি চায়নি। ‘আঁখিপল্লব’-এ প্রথমে ময়ূরীদি (মনোজ মিত্রর মেয়ে) করতেন। উনি চলে যাওয়ার পরে দলের অনেকেই বলেছিল, হোয়াই নট বুড়ু (রেশমী)? তখনও রাজি হয়নি। লাবণীদিকে (সরকার) নেওয়া হল। কিন্তু ‘মুখোমুখি বসিবার’ করার পরে ছবিটা বদলে গেল। তখন পাবলিক ডিমান্ডই তৈরি হয়ে গেল যে, আমাকে নিতে হবে!

পত্রিকা: কৌশিক, এসবই কারণ, না কি বৌ আপনার চেয়ে ভাল অভিনয় করলে কী হবে, তার ভয়?
কৌশিক: না। আমার মধ্যে কিন্তু অভিনেতার চেয়ে নিদের্শক সত্তাটা অনেক বেশি প্রবল। সুতরাং কেউ যদি ভাল করে, যদি আমার চেয়েও ভাল করে, ডিরেক্টর হিসেবে সেটা আমার ভাল লাগে। স্বীকার করতে বাধা নেই, আমার কিছু পুরনো ধরনের ধ্যানধারণা ছিল। কিছু অর্থোডক্স চিন্তা ছিল। সেগুলো আমারও ক্ষতি করেছে, তার চেয়েও বেশি বুড়ুর ক্ষতি করেছে। সেই চিন্তাভাবনাগুলো একটা ডমিনেশনের জায়গা তৈরি করে দিয়েছিল। ওর কতটা পোটেনশিয়াল আছে, আমি বুঝতেই পারিনি। বুঝতে চাইনি। শুধু থিয়েটার কেন! ‘এক আকাশের নীচে’ সিরিয়ালে যখন অদিতি (চট্টোপাধ্যায়) ছেড়ে দিল, রবি ওঝা বুড়ুকে চেয়েছিলেন। আমি করতে দিইনি। ওর সঙ্গে কথা না বলেই না বলে দিয়েছি। ‘হারবার্ট’-এর সময় মায়ের চরিত্রটার জন্য সুমন ওকে ভেবেছিল। আমি রাজি হইনি। কেন যে করেছি এ রকম! ওই যে বলে না, পেঁচোয় পাওয়া আমাকে পেঁচোয় পেয়েছিল তখন। ২৭ বছরের সম্পর্ক আমাদের। খুব স্ট্রং একটা বন্ড আছে। সেই জন্যেই এটা এখনও টিকে আছে। নইলে আমি যা যা করেছি, যে সব একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাতে এ সম্পর্ক টেকার কথা ছিল না।
পত্রিকা: যা যা করেছি মানে... অন্য সম্পর্কও? রেশমী, কোনও দিন সন্দেহ হয়নি ওঁকে?
রেশমী: (হেসে) আমি জানি, বাবান (কৌশিক) কত দূর কী করতে পারে।

পত্রিকা: এ তো পলিটিক্যালি কারেক্ট উত্তর। ওর মোবাইল চেক করেন? কোথায় কোথায় যান সব খোঁজ রাখেন?
রেশমী: (খুব হেসে) না, না। ওভাবে গোয়েন্দাগিরি করতে হয় না। জানি, যেখানে যাই হোক না কেন, বাবান আমাকে এসে বলবে। আসলে অনেক ছোটবেলার সম্পর্ক তো! বাবান টুয়েল্ভ, আমি টেন। সেই তখন থেকে। তবে রিলেশন কি হয় না ওর? হয় তো! অনেক বান্ধবী আছে ওর। কত জন ফোন করে কত দুঃখের কথা বলে!
কৌশিক: জোকস অ্যাপার্ট, একটা কথা বলি। নিশ্চয়ই আমার বেশ কিছু রিলেশন হয়েছে।

পত্রিকা: যেমন?
কৌশিক: প্লিজ...

পত্রিকা: ইন্ডাস্ট্রি, না বাইরে?
রেশমী: দুটোই।
কৌশিক: যাই-ই হোক, একটা পর্যায়ের পর আমি সেগুলোকে আর এগোতে দিইনি। তার কারণ, আমি কখনও চাই না, যার সঙ্গে এক সময় ভালবাসার সম্পর্ক ছিল, এমন একটা দিন আসুক, যে দিন তার সঙ্গে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়!

পত্রিকা: মিসেস সেনের ‘উদারতা’ বোঝা গেল। কৌশিক আপনার... এই ধরুন, ‘ম্যাকবেথ’ করতে গিয়ে মঞ্চে আপনি আর রেশমী বেশ কয়েক বার লিপ টু লিপ করছেন! আপনার জায়গায় যদি অন্য অভিনেতা থাকত, রেশমীকে অ্যালাও করতেন? অস্বস্তি হত না?
কৌশিক: হত। প্রথমটা হত। কিন্তু কাটিয়ে উঠতাম। এই একটা জায়গায় আমি একশো ভাগ সৎ। ইনফ্যাক্ট, ম্যাকবেথ চরিত্রটা কিন্তু প্রথমে আমার করার কথা ছিল না। অন্য ম্যাকবেথ খোঁজা হয়েছিল। তার পর ধরুন, ওই স্লিপ ওয়াকিং-এর দৃশ্যটা... আমি কিন্তু চেয়েছিলাম, রেশমীর সঙ্গে আমার অনেক আলোচনাও হয়েছিল যে, লেডি ম্যাকবেথ তখন যে পোশাকটা পরবে, তাতে তার শরীরের অনেকটা অংশই অনাবৃত থাকবে। এই ব্যাপারে আমাদের কোনও ইনহিবিশন নেই।

পত্রিকা: তাই? কানহাইয়ালাল-এর দ্রৌপদীর মতো চরিত্র? যেখানে মঞ্চে ‘আনড্রেসড’ হতে হয়?
কৌশিক: বিশ্বাস করুন, আমার নিজের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্ত দর্শক সেটা গ্রহণ করবে কি না, তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। যে দর্শক দ্রৌপদী দেখে উচ্ছ্বসিত হন, রেশমী ওটা করলে কিন্তু মানবেন না। উৎপল দত্তকে তো এ সব করতে হয়নি জাতীয় কথা বলবে!

পত্রিকা: আপনার নাটকে বারেবারে সিনেমা-সিরিয়াল বা অন্য সেলেব্রিটিদের দেখা যায়! এই পাব্লিসিটি স্টান্ট কেন দরকার হয় আপনার?
কৌশিক: আমি কিন্তু কখনও গ্ল্যামার বাড়ানোর জন্য কাউকে নিইনি। প্রয়োজনে নিয়েছি। এবং যাঁদের নিয়েছি, আমার দলে কাজ করে ধন্য করে দেবেন, এমন মন নিয়ে কেউ আসেননি।

পত্রিকা: বারবার যদি বাইরে থেকে লোক নেওয়ার প্রয়োজন হয়, সেটা কি একটা দলের ব্যর্থতা নয়?
কৌশিক: সব সময় সব চরিত্রের উপযোগী চেহারা কিন্তু সত্যিই থাকে না। ‘সেই সুমৌলি’-তে দেবদূতের চরিত্রটা আমি করতে পারতাম। কিন্তু তাহলে দর্শক প্রথম থেকেই চরিত্রটার গতি বুঝে যেতেন। তার পর ধরুন, ‘সুপ্রভাত’-এ রূপা (গঙ্গোপাধ্যায়)। ওয়ার্কিং উওম্যান। একটু বয়স হয়েছে। চেহারা ভারী হয়েছে। এইটা করার মতো কেউ তো ছিল না দলে! ‘সমুদ্রের মৌন’-তে কবীর সুমন। উনি তো অভিনেতা নন! কিন্তু ওঁর চেহারা, ব্যক্তিত্ব, গলা মঞ্চে বসে থাকলেই অর্ধেক কাজ হয়ে যেত! এই যে ‘কালসন্ধ্যা’য় ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) করার কথা ছিল! কেন? চেহারাটার জন্য! ‘কালসন্ধ্যা’র কৃষ্ণের তো শরীর ভেঙে গেছে! তিনি তো আর সেই মনমোহন নন! কিন্তু প্রজ্ঞাটা আছে। ওই জন্যই ঋতুদা। হ্যাঁ, বলতে পারেন, ‘ভয়’-এ দেবলীনার (দত্ত) কথা। ওটা শুধু প্রয়োজনে নেওয়া নয়। দেবলীনা আমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছিল। সেই জন্য নেওয়া। টিভি বা সিনেমার অনেকে অনেক সময় এ রকম বলেছেন আমাকে। রাহুল যেমন। আমি তাঁদের সেই ইচ্ছেটাকে সম্মান করি। আমার মনে হয়, এতে নাটকের ভালই হয়। খারাপ হয় না।

পত্রিকা: ‘নটীর পূজা’য় অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়? ওটাও প্রয়োজনে?
কৌশিক: ‘নটীর পূজা’য় কতগুলো মেয়ে চরিত্র ভাবুন! প্রয়োজন তো ছিলই। তা ছাড়া অর্পিতাকে নেওয়ার পিছনে আর একটা বড় কারণ ছিল, গান। ইন ফ্যাক্ট, ঋতুদা নাটক দেখে বলেছিলেন, ‘আর রেখো না আঁধারে’ গানটার সময় থেকে অর্পিতার অভিনয় ওঁর ভাল লেগেছে।

পত্রিকা: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘অশ্বত্থামা’ হল না কেন? সময়াভাব, না অন্য কোনও কারণ?
কৌশিক: না না, একেবারেই সময়ের কারণে। বুম্বাদা আসলে মাঝখানে একটা ব্রিদিং স্পেস পাবেন ভেবেছিলেন। পেলেন না। পরপর কাজ পড়ে গেল। বুম্বাদা কিন্তু নিজে চেয়েছিলেন কাজ করতে। বলেছিলেন, দ্যাখ এখন তো সব অন্য রকম ছবি করছি! একটু প্র্যাকটিস করা দরকার। একটু ঘষামাজা দরকার। আমি ওঁকে দুটো স্ক্রিপ্ট শুনিয়েছিলাম। জয় গোস্বামীর ‘ঘাসফুলের কবি’ আর ‘অশ্বত্থামা’। ‘ঘাসফুল’ শুনে উনি বলেছিলেন, এ রকম চরিত্র আমি আগে করেছি। এমন চরিত্র দে, যেটা করতে ভয় লাগবে। মনে হবে, পারবই না। তখন ‘অশ্বত্থামা’ ঠিক হয়।
পত্রিকা: আর কোনও স্টারের কথা মাথায় আছে? বা কেউ আপনার সঙ্গে থিয়েটার করতে আগ্রহী হয়ে কথা বলেছেন?
কৌশিক: রিনাদির (অপর্ণা সেন) তো ইচ্ছে করে। আমার মনে হয়, এখনও উনি করলে সাঙ্ঘাতিক ভাল করবেন। ‘অমাবস্যার গান’ বলে একটা নাটক করার কথা ভেবেছিলাম। ভারতচন্দ্রের রোলে অর্জুন চক্রবর্তীকে নেব ঠিক করেছিলাম। অর্জুনদার গানের কথা ভেবে। শাশ্বত (চট্টোপাধ্যায়), রনি (রজতাভ দত্ত), শঙ্কর (চক্রবর্তী)-- এরা খুব ভাল কাজ করতে পারে।

পত্রিকা: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত?
কৌশিক: ঋতুপর্ণা নাটক দেখতে আসে নিয়মিত। বলেও মাঝে মাঝে। কিন্তু আমি জানি, ও আজ বলবে। কাল ফোন করলে শুনব সিঙ্গাপুরে বসে আছে! (হাসি) আর একটা স্বপ্ন ভেতরে ভেতরে লালন করি। জানি না, হবে কি না কোনও দিন। যদি, নাসির কোনও দিন কাজ করেন। সুমন একটা সিরিয়াল করেছিল ‘তারকশ’। তাতে উনি আর আমি একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম। তখন মঞ্চে ‘টিকটিকি’ও হত। ওই সময়ই আমি নাসির আর রত্না পাঠক শাহর ‘ডিয়ার লায়ার’ বলে একটা নাটক দেখি। শ্যুটিং-এর ফাঁকে ওঁর সঙ্গে নাটক নিয়ে অনেক কথা হত। আমার দুই দেবতা আছেন, জানেন! এক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর দুই নাসিরুদ্দিন শাহ! ঋতুদা তো আর নেই... কৃষ্ণের চরিত্রটা যদি নাসিরুদ্দিন...। দেখা যাক!

পত্রিকা: অনেকে বলছেন, থিয়েটারের এখনকার এই বাড়বাড়ন্ত অনেকটাই মিডিয়া হাইপ!
কৌশিক: আপনাদের কাগজেই একটা লেখা পড়ছিলাম এই নিয়ে। লেখাটার সঙ্গে আমি কিছুটা একমত, কিছুটা নই। দেখুন, ‘চাক ভাঙ্গা মধু’র সময় আর এই সময়ের মধ্যে তুলনা করে লাভ নেই। তখন বিনোদনের কী কী মাধ্যম ছিল আর এখন লোকের হাতে কী কী অপশন আছে, সেটা তো ভাবতে হবে। হ্যাঁ, বলতে পারেন, মিডিয়া আজ যদি থিয়েটারকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে কি থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবে? না, তা হবে না। কিন্তু মিডিয়ার প্রচার চাওয়ার মধ্যে দোষের তো কিছু নেই! ক’টা বাংলা ছবি ইন্ডিয়ান প্যানোরামায় গেল, সেটা যদি খবর হতে পারে, তা হলে এই যে ১২টা বাংলা নাটক ৬ থেকে ২০ জানুয়ারি এনএসডি-র ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল ‘রং মহোৎসব’-এ যাচ্ছে, সেটা লেখা হবে না কেন? হ্যাঁ এটা ঠিক যে, ‘সিনেমার মতো’ নিয়ে মিডিয়ায় প্রচুর লেখা হয়েছে। কিন্তু তা দিয়ে কি বলা যায়, নাটকটা শুধু হাইপে চলছে? ‘রাজা লিয়ার’, ‘দেবী সর্পমস্তা’, এগুলো সব হাইপে চলেছে? ব্রাত্যর সব নাটকে কি শহরে হোর্ডিং পড়েছে? ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ বা ‘১৭ই জুলাই’? না। গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে একটা চার্নিং হয়েছে। ইয়ং জেনারেশন নাটক দেখতে আসছে। নতুন দর্শক তৈরি হয়েছে। সুমন যে আবার ‘মেফিস্টো’ করার কথা ভাবছে, আমি ‘শাহজাদা দারাশুকো’ করব ভাবছি, সেটা এই দর্শকের জন্যেই।

‘স্বপ্নসন্ধানী’ গত দু’বছরে
একটা রবিবার হল
পেয়েছে। সেখানে ‘ব্রাত্যজন’ লাগাতার শনি-রবি পাচ্ছে।
রিনাদির তো ইচ্ছে করে
থিয়েটার করতে। আমার
মনে হয়, উনি এখনও
সাঙ্ঘাতিক ভাল করবেন।
আমার দুই দেবতা
আছেন, জানেন!
একজন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
দ্বিতীয় জন হলেন
নাসিরুদ্দিন শাহ!

পত্রিকা: নাটকের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে আপনার এখন যোগাযোগ কেমন? ব্রাত্য-সুমন-দেবেশ?
কৌশিক: ব্রাত্য-সুমনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশি ছিল। বহু দিনের সম্পর্ক। মিনার্ভা নিতে চেয়ে বুদ্ধবাবুর কাছে যাওয়া, নন্দীগ্রাম পর্ব অনেকটা সময় একসঙ্গে কেটেছে। দেবেশ সেই অর্থে আমার বন্ধু ছিল না। তবে ব্রাত্যকে নিয়ে ফেস্টিভ্যালটা করার সময় দেবেশ খুব সাহায্য করেছিল। মরাল সাপোর্ট দিয়েছিল। সেই সময়টা আমরা কিছুটা কাছাকাছি এসেছিলাম। কিন্তু বন্ধু বলতে যা বোঝায়, ব্রাত্য-সুমন যে অর্থে আমার বন্ধু ছিল, সেটা ও ছিল না। সুমনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। ভালই যোগাযোগ আছে।

পত্রিকা: ব্রাত্যর সঙ্গে কী হল?
কৌশিক: কী হল বলুন তো? জানি না কিন্তু। কিছু কি হল?

পত্রিকা: হয়নি বলছেন? এখন ব্রাত্য বসুর কোনও নাটক আপনি করবেন?
কৌশিক: কেন করব না? ইন ফ্যাক্ট, ব্রাত্যর অফবিট নাটকগুলো তো আমিই বেশি করেছি। ‘মুখোমুখি বসিবার’, ‘দর্জিপাড়ার মর্জিনারা’, ‘ভয়’...। ‘ঈশ্বর, প্রেম ও যৌনতা’ বলে একটা নাটক...ওঃ কী লিখেছিল! ওটাও আমার করার কথা ছিল। আজও যদি সে রকম কোনও টেক্সট পাই, অবশ্যই ওর সেক্রেটারিকে বলব।

পত্রিকা: সেক্রেটারি কেন? ওঁর নম্বর নেই আপনার কাছে?
কৌশিক: তা অবশ্য নেই।

পত্রিকা: এক সময়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। অথচ আজ ফোন নম্বরটাও নেই —এটাই কি অনেক কিছু বলে দিচ্ছে না, কৌশিক?
কৌশিক: দেখুন, দূরত্ব একটা এসেছে। কিন্তু সেটা ঠিক কবে, কী থেকে হল, আমি সত্যি জানি না।

পত্রিকা: ব্রাত্য যখন তৃণমূলপন্থী হলেন আর আপনি হলেন না, সেটাই কি সূত্রপাত নয়? তার পর ব্রাত্য ফেস্টিভ্যাল করাটা কি অনেকে তো বলেন একটা প্যাচ আপের চেষ্টা ছিল আপনার?
কৌশিক: না। ওই সময় কিন্তু কোনও দূরত্ব ছিল না। আমাদের অবস্থান আলাদা ছিল। তাই নিয়ে কথা হত, তর্ক হত। কিন্তু দূরত্ব হয়নি। ব্রাত্য আমাদের সময়ে সবচেয়ে ইম্পর্টান্ট নাট্যকার বলে আমি মনে করি। সেই জায়গা থেকেই ওর নাটকগুলো নিয়ে ফেস্টিভ্যাল করার কথা হয়। এটা অনেক আগের ভাবনা। তখনও ব্রাত্য ইলেকশনে দাঁড়াবে, সেটা ঠিকই হয়নি। তার পরে ও ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে বলেই ফেস্টিভ্যাল করব না, লোকে কী বলবে, এগুলো ভাবতে চাইনি। এইখানেই দেবেশ খুব সাপোর্ট দিয়েছিল।

পত্রিকা: তার পর কী হল? আপনি তো ৫টা নতুন ‘ব্রাত্যজন’ হওয়ার সময় ফুল পাঠিয়েছিলেন। লোকজন বলে সেটাও আসলে একটা প্যাচআপের চেষ্টা...
কৌশিক: হ্যাঁ, পাঠিয়েছিলাম। ৫টা ব্রাত্যজন হওয়া আমি ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করি কি না, সেটা এখানে বড় কথা নয় বলেই আমার মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এটা একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা। তার পর ধরুন, রবীন্দ্রভারতীর মুভমেন্টের সময় ব্রাত্যর সঙ্গে একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। কথা হল, তর্ক হল। কিন্তু হেলদি তর্ক।

পত্রিকা: তা হলে কি নাট্যকর্মী বিমল চক্রবর্তীর মার খাওয়ার ঘটনার সময় থেকে দূরত্বটা তৈরি হল?
কৌশিক: হতে পারে, ওই সময়েই হয়তো দূরত্বটা...!

পত্রিকা: ব্রাত্যর ‘সিনেমার মতো’ দেখবেন না?
কৌশিক: না।

পত্রিকা: কেন? ব্রাত্যর নাটক করতে রাজি আছেন আর দেখতে রাজি নন?
কৌশিক: ঠিক তা নয়। যাব কি না জানি না। আসলে দূরত্ব একটা হয়ে গেছে, এটা ঠিক। যাব না-ই বলছি না। তবে প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথম দিকে নেই।

পত্রিকা: থিয়েটারের কোনও সমস্যা নিয়ে কথা বলার দরকার হলে ব্রাত্যকে ফোন করবেন?
কৌশিক: থিয়েটারের সমস্যা নিয়ে আমি আলাদা করে কী বলব? তার জন্য তো ‘নাট্য অ্যাকাডেমি’ আছে। আর এই হল পাওয়া, ডেট পাওয়ার সমস্যা নিয়ে গুজগুজ -ফুসফুস আমার ভাল লাগে না। আমাকে সকলে ফোন করে! যার যা নালিশ শোনায়। বলে, তুমি বলো! আমি কেন বলব? আমি প্রতিবাদী বলে? ‘স্বপ্নসন্ধানী’ গত দু’বছরে একটা রবিবার হল পেয়েছে। সেখানে ‘ব্রাত্যজন’ লাগাতার শনি-রবি পাচ্ছে। এটা সবাই আমাকে ফোন করে বলবে, সামনে বলবে না। আমি এর মধ্যে ঢুকতে চাই না।

পত্রিকা: আর ব্রাত্য যদি চান? ব্রাত্য ‘পত্রিকা’-রই একটি সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, এখানে পৃথ্বী থিয়েটারের মতো যদি কিছু করা যায়! সে ব্যাপারে আপনাকে ডাকলে যাবেন?
কৌশিক: টু হান্ড্রেড পারসেন্ট। অবশ্যই যদি অসরকারি উদ্যোগ হয়।

পত্রিকা: সরকারি উদ্যোগ হলে?
কৌশিক: যে কারণে আমাকে ডাকা হচ্ছে, সেই দায়িত্বটুকু পালন করে চলে আসব। কমিটিতে ঢুকব না, সিস্টেমটার পার্ট হব না। কোনও মিটিংয়ে ডাকলে যাব, ব্যস্। ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্র্যাক্টিশনার হিসেবে যাব।

পত্রিকা: কৌশিক সেনের নাটক নিয়ে লোকজনের একটা অভিযোগ, যে করে হোক, সমসাময়িক রাজনীতির কথা গুঁজে দেওয়া আজকাল আপনার প্রি-ফিক্সড্ এজেন্ডা হয়ে গেছে।
কৌশিক: হ্যাঁ, এটা কেউ কেউ বলেছেন ঠিকই। যেমন, ‘ম্যাকবেথ’-এ ওই ‘দশ বছরের কাজ দশ দিনে শেষ করা’র সংলাপটা কী প্রয়োজন ছিল, এটা অনেকে বলেছেন। অশোক সেন, শঙ্খ ঘোষও বলেছেন। কিন্তু কী জানেন, ২০০৭ থেকে আসলে ভেতরে এমন একটা অ্যাজিটেশন তৈরি হয়েছে না! তার পর থেকে প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, একদম এই সময়টার কথা যেন থিয়েটারে রাখতে পারি। দরকার হলে শিল্পগুণ একটু ক্ষুণ্ণ করেও এই মুহূর্তটা ধরব। ভাসা ভাসা নয়, তেমন হলে একটু আন্ডারলাইন করেই বলব। একটা গ্রিক নাটক দেখে লোকে কামদুনি বুঝে নেবে, এটা ভেবে বসে থাকব না। এটা আমার সিদ্ধান্ত।

পত্রিকা: কিন্তু থিয়েটারের ভেতরে, থিয়েটারের বাইরে এই যে আপনার সদাসর্বদা প্রতিবাদী ভাবমূর্তি, এটাও কি একটা ক্যালকুলেটেড পাব্লিসিটি স্টান্ট নয়?
কৌশিক: ক্যালকুলেটেড হওয়া সম্ভব না। রেশমী সবচেয়ে বেশি জানে এটা। নন্দীগ্রামের পরে সেই ব্রাত্যর পথনাটক নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো। আর ক্যালকুলেটেড পাব্লিসিটি তো মানুষ করে লাভের জন্য? আমার এ সবে কী লাভ হয়েছে? বরং মূল্য চোকাতে হয়েছে অনেক। বাইরে থেকে হয়তো বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু ব্যক্তিগত, দলগত অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।

পত্রিকা: কিন্তু ইদানীং আপনার অ্যাক্টিভিস্ট সত্তা আপনার নাট্যকর্মী সত্তাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে না কি?
কৌশিক: গত দু-তিন মাস ধরে রেশমী ঠিক এই কথাটা আমাকে বলছে। আমি এটা নিয়ে ভাবব। এবার ভাবছি একটু গোটাব নিজেকে।
রেশমী: আর বলবেন না, সর্বক্ষণ ফোন আসছে! কার কলে জল আসছে না, কে গোবর গ্যাস তৈরি করেছে, তারাও ওকে ফোন করছে! ওকে বললে নাকি উপায় হবে! আচ্ছা, এটা কি ওর কাজ?

পত্রিকা: শেষ প্রশ্ন, রেশমীকে। পরিচালক কৌশিক, অভিনেতা কৌশিক, স্বামী কৌশিক, বাবা কৌশিক, দশে কে কত পাবেন?
রেশমী: পরিচালক দশে দশ, অভিনেতা দশে নয়, স্বামী দশে পাঁচ। আর বাবা?—ওরে বাবা, দশে বারো! ধৃতরাষ্ট্রের পরেই!!!! (হাসি)

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
কৌশিকের পছন্দ
নাট্যদম্পতি নির্দেশক
১. দেবেশ-কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
২. সুরজিৎ-অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. গৌতম-দ্যুতি হালদার
৪. আশিস চট্টোপাধ্যায়-দীপা ব্রহ্ম
৫. কৌশিক-রাত্রি চট্টোপাধ্যায়
১. সুমন মুখোপাধ্যায়
২. দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
৩. গৌতম হালদার
৪. বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় ও চন্দন সেন
৫. ব্রাত্য বসু
অভিনেতা অভিনেত্রী
১. সুরজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
২. গৌতম হালদার
৩. দেবশঙ্কর হালদার
৪. রজতাভ দত্ত ও কাঞ্চন মল্লিক
৫. অর্ণ মুখোপাধ্যায়
১. সোহিনী সেনগুপ্ত ও রেশমী সেন
২. মনীষা আদক
৩. কস্তুরী চট্টোপাধ্যায়
৪. পৌলমী চট্টোপাধ্যায়
৫. তূর্ণা দাস


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.