স্মরণ ১
আমায় কেউ পাত্তাই দিল না
জ যদি বাবা বেঁচে থাকতেন, তা হলে সচিন তেন্ডুলকরের অবসরের খবরটা, আমি নিশ্চিত, ওঁর চোখে জল এনে দিত।”
এই ‘বাবা’ মানুষটি হলেন সলিল চৌধুরী। বলছেন তাঁর কন্যা অন্তরা চৌধুরী।
“বাবা খুব ক্রিকেটের ভক্ত ছিলেন। সুনীল গাওস্কর ছিলেন তাঁর অসম্ভব প্রিয় ক্রিকেটার। কাজের ফাঁকে প্রায়ই দেখতাম টিভি খুলে মন দিয়ে ক্রিকেট দেখছেন। এমনও হয়েছে, আমাকে বলেছেন : ‘মানু, তুই একটু জল এনে দিবি এখানে। আমি তো চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারব না, উঠলেই কেউ আউট হয়ে যাবে! জাভেদ মিঁয়াদাদের খেলাও খুব পছন্দ করতেন বাবা। সচিনকে খেলতে দেখেছেন কয়েকটা বছর। তাতেই বলতেন, ‘হি ইজ্ ব্রিলিয়ান্ট। হি উইল গো ফার!”’ বললেন অন্তরা।
তবে অবসরের খবর শুনে চোখে জল আসত কেন? “আরে, বাবা ছিলেন ভীষণ সফটি।” বলেই ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা বললেন তিনি।
‘আনন্দ’-এর সেই শেষ দিকের দৃশ্যগুলো মনে আছে, যেখানে রাজেশ খন্না বলছেন, ‘বাবুমশাই...?’
ছবিটা মুক্তি পাওয়ার বহু পরে একদিন টিভিতে তা দেখানো হচ্ছিল। দেখতে দেখতে সলিল চৌধুরীর চোখ ছলছল করে উঠেছিল। “আমি বললাম, কী হল বাবা? ... বলতেই দেখি কান্না চেপে বাথরুমে চলে গেলেন, যাতে তখন ওঁকে কেউ দেখতে না পান। ‘আনন্দ’-এর মিউজিকটা বাবার করা। এত বার সিনেমাটা দেখেছেন। তাও ওই দৃশ্যটা এলে কিছুতেই চোখের জল সামলাতে পারতেন না।... এই হলেন আমার বাবা। তাই বলছি, সচিনের শেষ ইনিংসটা দেখলে ওঁর চোখে জল আসতই। আনন্দে-বিষাদে চোখ ছলছল করে উঠত,” বলছিলেন অন্তরা।
যে মানুষটি অসম্ভব দাপটের সঙ্গে এত রকমের কাজ করে গিয়েছেন, তাঁর চোখে এত সহজে জল আসত?
শুনে অবাক লাগতে পারে। কিন্তু এমন অসংখ্য ঘটনায় জড়িয়ে থাকা মানুষটিই সলিল চৌধুরী। হয়তো’বা অচেনা, অধরা, অন্তচারী সলিল চৌধুরী।
তাঁর কাছের মানুষেরা বলেন, যে মাপের মানুষ ছিলেন তিনি, যত ধারায় তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল, সে তুলনায় তাঁর বিভিন্ন দিক নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি।
‘সুরকার’ সলিল চৌধুরীর আড়ালে বারবার ঢাকা পড়ে যান গল্পকার সলিল, চিত্রনাট্যকার সলিল, কবি সলিল...।
কম্পোজার শান্তনু মৈত্র একবার তাঁর ফিল্ম দুনিয়ার বন্ধুদের নিয়ে একটা ‘ভোট’ করেছিলেন। প্রশ্নটি ছিল, ‘দো বিঘা জমিন’-এর গল্পটি কার লেখা। খুব কম জনই সঠিক উত্তরটি দিতে পারেন। “ওটা যে সলিলদার লেখা জানতেন না অনেকেই। আমি মনে করি, সলিলদার কলমের এত জোর ছিল যে উনি ভারতীয় চলচ্চিত্রেরই ভোল বদলে দিয়েছিলেন,” বললেন শান্তনু।
ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে যে মানুষের এত বড় অবদান, তাঁকে ফিল্ম দুনিয়া এ ভাবে ভুলে গেল কী করে? শুধু ‘দো বিঘা জমিন’-এর ঘটনাটিই নয়, সলিল চৌধুরী গান-অনুরাগীদেরই বা ক’জন আছেন, যাঁরা জানেন, তিনি একটি হিন্দি সিনেমাও পরিচালনা করেছিলেন। ছবির নাম ছিল ‘পিঞ্জরে কে পঞ্ছি’। অভিনয়ে মেহমুদ আর মীনাকুমারী।
“সত্যিই খুব কম মানুষ আছেন, যাঁরা ছবিটির কথা জানেন। গানগুলো অবশ্য আমি ছবি রিলিজ হওয়ার পরে শুনেছি। এই প্রসঙ্গেই আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। ‘হাফ টিকিট’ বলে যে ছবিটা, তার গানগুলো বাবার সুর করা। প্রথমে একদমই কদর পায়নি। পরে দেখলাম, লোকজন হই হই করে শুনছে,” বললেন অন্তরা।
বিমল রায়ের ছবি ‘পরখ’। সলিল চৌধুরীর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘ও সাজনা বরখা বাহার আয়ি’ আজও জনপ্রিয়। কিন্তু ক’জনই বা জানেন, এ ছবির গল্পটিও সলিলেরই?
সঙ্গীতজগতের আরেক প্রবীণ শিল্পী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “রবীন্দ্রনাথের অভিমতের সঙ্গে সহমত হয়ে বলতে পারি, কবিতা এখন ইন্টেলেক্টের পুজো করছে। হৃদয়ের নয়। কবিতা এখন পণ্ডিতদের ঋত্বিক, রসের পুজারি না। নীতির পুরোহিত কিন্তু ভালবাসার সাধক না। সলিল চৌধুরী চিরদিন হৃদয়ের পথ ধরেই সৃষ্টিশীল। তাই ‘এক গুচ্ছ ছবি’, ‘শপথ’-এর কবি আধুনিক কবিদের তালিকায় জাতে উঠতে পারল না।” তিনি আরও বললেন, “সলিল চৌধুরী লড়াই থেকে পালিয়ে যাননি, মুম্বইয়ের মতো বিনোদনসর্বস্ব ফিল্ম জগতে ‘দো বিঘা জমিন’, ‘পরখ’-এর মতো কাহিনির পটভূমি দিয়ে জীবনধর্মী কাহিনি রচনা করেছেন। অনেক চিত্রনাট্য লিখেছেন। বি আর চোপড়ার মতো চিত্র পরিচালক গানের সুর ভিন্ন সঙ্গীত পরিচালককে দিয়ে করিয়েও সঙ্গীত ও জীবন যে পরিপূরক তা বোঝাতে আবহসঙ্গীত রচনা করিয়েছিলেন সলিল চৌধুরীকে দিয়ে। গল্প, নাটক, কবিতা এমনকী শেষ বয়েসে ছবি আঁকা পর্যন্ত যে বিচিত্রগামী প্রতিভা সলিল চৌধুরীর ছিল, রবীন্দ্রনাথের পর আর সেরকম দেখা যায় না।”
সলিল চৌধুরীর লেখা ‘ড্রেসিং টেবিল’ নামে একটি গল্প নিয়ে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় একবার সিনেমা করতে চেয়েছিলেন। “দেশভাগের সময়ে একটা ড্রেসিং টেবিল এদেশে চলে আসে। তার মধ্যে পাওয়া যায় একটি চিঠি। সেখান থেকেই গল্পটির শুরু। হৃষীকাকা চেয়েছিলেন গল্পটা নিয়ে সিনেমা করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাবা গল্পটার কোনও চিত্রনাট্য করে যাননি,” বলছিলেন সলিল-কন্যা।
ছবি: অরুণ চট্টোপাধ্যায়
একটি টিভি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে গিয়েছিলেন তিনি। চব্বিশটি পর্বে তৈরি করার কথা ছিল সেই সিরিয়াল। হিন্দিতে স্ক্রিপ্টটার নাম ছিল ‘ইয়াদগার’। ইংরেজিতে ‘আইডেনটিটি অব আ ম্যান’। “একজন মানুষ ঘুম থেকে উঠে কাউকে চিনতে পারেন না। আর তারপর নিজের আইডেনটিটির খোঁজে বেরন। এই নিয়েই গল্পটা। দূরদর্শন-এর জন্য তৈরি হত। বাবার পরিচালনা করার কথা ছিল। অভিনয়ের জন্য দেবশ্রী রায় আর কানওয়ালজিৎ সিংহ-র সঙ্গে কথাও হয়েছিল। কাজটা করতে করতে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ক্রিপ্ট হিসেবেই বাবার লেখাটা দারুণ। আমাদের ইচ্ছে, যদি পরিচালক গৌতম ঘোষ এটা নিয়ে কাজ করেন। একটা বাংলা ছবির স্ক্রিপ্টও বাবা লিখে গিয়েছিলেন, নাম ছিল, ‘এই ঋতুর এক দিন’, জানালেন অন্তরা।
শান্তনুর ধারণা, এ দেশে মাল্টি টাস্ক করতে পারা প্রতিভাকে ‘হ্যান্ডেল’ করতে জানেন না অনেকেই। অর্থাৎ, বহু কাজ একসঙ্গে করতে জানা প্রতিভাবানদের আমরা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারি না। তাঁদের কাজের সব ক’টি ধারা কিছুতেই সমান ভাবে নজরে আসে না। “রবীন্দ্রনাথের কথা বলতে গেলে প্রথমেই কি আমরা বলি, উনি খুব ভাল ছবি আঁকতেন? না। সলিলদার ক্ষেত্রেও তাই। সঙ্গীতের বাইরে তাঁর অন্য দিকগুলো নিয়ে তেমন চর্চাই হয়নি,” বললেন শান্তনু। এ নিয়ে গুলজারসাবের সঙ্গেও একবার কথা হয় শান্তনু মৈত্রর। “গুলজারসাব বিমল রায়ের সহকারী ছিলেন। অনেক কথা শুনেছিলেন সলিলদা সম্পর্কে। বারবার শুনেছি ওঁকে বলতে, সলিলদার লেখা বড়ই সিনেম্যাটিক। এমনকী বিমল রায় না কি বলতেন, ‘সলিলের সুর তো ছবি আঁকে।’ গল্প বলার একটা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল ওঁর। কখনও সেটা সঙ্গীতের মধ্যে প্রকাশ পেত, কখনও লেখায়। সলিলদার প্রত্যেকটি গান-এর ইন্টারলিউডটাও একটা আলাদা গান। গান লেখা, সুর করা আর অ্যারেঞ্জ করা এই তিনটি কাজ এক সঙ্গে তিনি করেছেন। তিনটিতেই তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন,” বলছিলেন শান্তনু।
সলিল চৌধুরীকে অনেকেই বলতেন ইনটেলেকচুয়াল কম্পোজার। অঙ্কটা মাথায় রেখে সুর করতেন। একই গান হয়তো তিনটে ভাষায় গাওয়া হবে। কম্পোজ করার সময় তিনটে আলাদা অ্যারেঞ্জমেন্ট করতেন। বাংলায় গানটা হয়তো ফোকের মতো শোনায়। সেই একই গান হিন্দিতে প্রচণ্ড সিডাকটিভ। আর সেইটাই যখন মালয়ালম হচ্ছে, মনে হত হয়তো মেছুনিদের লোকগান। তাঁর বাবার লেখা নিয়ে বলতে গিয়ে অন্তরা জানান সেখানে সব সময় সোশ্যাল মেসেজ থাকত। মানুষকে জাগানোর চেষ্টা। “বাবা ছিলেন লাজুক স্বভাবের। হি ওয়াজ আ থিঙ্কার। কিন্তু নিজের ঢাক নিজে পেটাতেন না। বাবার অ্যাটাচেতে সব সময় সারি সারি পেন রাখা থাকত। যে দেশেই যেতেন সেখান থেকে পেন কিনে আনতেন। বলতেন: ‘আমার নিশ্বাস হচ্ছে আমার কলম!’”
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায় এক সাক্ষাৎকারে সলিল চৌধুরীর মন্তব্য। উনি বলেছিলেন, “আমি জানি না, কোনটা নিয়ে চলব: কবিতা, গল্প লেখা, অর্কেস্ট্রেশন, না ফিল্মের গান কম্পোজ করা। ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই আমার কাজ। যখন যেটা সেই মুহূর্তটায় বা আমার মানসিক অবস্থার সঙ্গে খাপ খায়, সেটা নিয়ে কাজ করি।”
অসীম ক্ষমতাধর মানুষদের ভাবনা তো এমনই হয়। তবু আক্ষেপ তো থাকেই। ঠিক যেভাবে অন্তরার কাছে তিনি বলেছিলেন: “আমায় কেউ পাত্তাই দিল না, আমি যাওয়ার পঞ্চাশ বছর পর দেখবি, লোকে আমার গান নিয়ে রিসার্চ করবে...।” যদি এই একটা জায়গাতে সলিল চৌধুরী ভুল প্রমাণিত হন... সে-গবেষণার কাজ শুরু হয়ে যায় ওঁর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পেরোনোর অনেক আগেই...!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.