|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
অথরিটি নিয়ে কথা বলতেন, প্রবল ঝাঁঝে |
খুব ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে দেখেছি দাদাকে। আমাদের অঙ্কের খাতা টেনে নিয়ে ছবি আঁকতেন ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে। কত ছবি। লেখার মতো কতক ছবি নিয়েছেন, কতক ফেলে দিয়েছেন। যত্নই করতেন না ছবির।’ শানু লাহিড়ী বলেছেন কমলকুমার সম্পর্কে, ‘সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। যা অন্যায় তার বিরুদ্ধে দাদা ছিলেন সবসময় সোচ্চার। রায়টে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাইকে উদ্ধারের কাজে জীবনপণ করেছিলেন।... তখন ১৯৪০-৪১ সাল। একটা হুডখোলা গাড়িতে চেপে আমাদের পাড়ায় এসে একজন সাহেব কোনও বাঙালি মেয়েকে অপমান করে। দাদা ব্যাপারটা দেখে সাহেবকে বেধড়ক মার মেরেছিলেন। তারপর থেকে সাহেবটা আর আমাদের পাড়ায় আসেনি।’ এমন আরও কত অজানা আলোয় উদ্ভাসিত কমলকুমার মজুমদার (১৯১৪-১৯৭৯) তাঁর জন্মশতবর্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিতীর্থ-এর (সম্পা: উৎপল ভট্টাচার্য)। শানু লাহিড়ীর পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়, অশোক মিত্রেরও সাক্ষাৎকার তাঁকে নিয়ে। তাঁর জীবনপঞ্জি, রচনাপঞ্জি তৈরি করেছেন হিরণ্ময় গঙ্গোপাধ্যায় যত্নে-পরিশ্রমে। রয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকার: ‘একবার বিষ্ণু দে মশাই লিখে দিলেন আমি নাকি ফ্রেঞ্চ সিনট্যাক্স-এ লিখি। প্রথমত আমার ওসব সম্বন্ধে জ্ঞানও নেই। ফ্রেঞ্চ সিনট্যাক্স কাকে বলে কী বলে আর উনি কোত্থেকে জ্ঞান পেয়েছেন তাও আমি জানি না।’ আছে তাঁর রচনাও প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক। চিঠিপত্র তাঁর লেখা এবং তাঁকে লেখা। বিশিষ্ট গদ্যকারদের কলমে মূল্যায়নও তাঁকে নিয়ে। সঙ্গে তাঁর হাতের লেখা, ছবি আঁকা, নানা বয়সের ছবি। |
|
‘গদ্যে আমরা অত্যন্ত সরল, খুকু গদ্য ও সাহিত্য যাহা ইদানীং চলিত, তাহা বাংলা নয়, প্রতিদিন এক এক শব্দ বহুল ব্যবহারে ধ্বস্ত হয়, সেই সেই শব্দকে বাঁচাইতে আমরা আমাদের পবিত্র উচ্চশ্রেণিগত বংশধারা ও মর্যাদা অনুযায়ী চেষ্টা করিব।’ স্রোতে গা-ভাসিয়ে দেননি কমলকুমার মজুমদার। দেননি বলেই পাঠক প্রবল ধাক্কা খেয়েছে, সে ধাক্কা এতটাই যে জটিল গদ্যের প্রায় পারিভাষিক প্রতিশব্দই হয়ে উঠেছে ‘কমলকুমার’। শতবর্ষে পৌঁছে কমলকুমার তাই আর নিছক এক লেখক নন, একটা ফেনোমেনন। তারই নানা দিক থেকে চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু বছর ধরে কমলকুমার-চর্চা করে চলেছেন প্রশান্ত মাজী। তাঁর কমলকুমার (পারুল, ১০০.০০) বিচিত্র সেই জীবনের পরিচয়। কমলকুমারের প্রকাশিত, অপ্রকাশিত, অগ্রন্থিত রচনা ও চিঠিপত্র, নোট্স সম্পাদনা করতে গিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া, নানা পাঠ তৈরি হয়েছে লেখকের। সে সবই একটা চেহারা পেয়েছে এ বইয়ে। প্রথম লেখাটি কমলকুমারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারের, ‘কমলকুমার: শ্রীরামকৃষ্ণের নিঃশব্দ অনুগামী’। পরে বিভিন্ন লেখায় সুন্দর ফুটে উঠেছে কমলকুমারের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বটি। ‘সকলকে সম্মোহিত করতে পারতেন বিচিত্র সব বিষয়ে কথা বলে সুন্দরবনের ইটিন্ডা ঘাটের তৈরি মাটির পাত্র তৈরির প্রণালী বিষয়েই হোক বা সাহিবদের কাছে কলার মোচা কী করে কাটতে হয় তার বর্ণনা করেই হোক, অথরিটি নিয়ে কথা বলতেন প্রবল ঝাঁঝে ফলে তাঁর সঙ্গে তর্ক করবে কে?’ সেই তর্ক হয়তো এখন নতুন করে জমে উঠবে, কমলকুমারের জীবন ও রচনা নিয়ে বহু ‘মিথ’ ভেঙে যাবে। শতবার্ষিক মূল্যায়নে সেটাই হওয়া উচিত।
তাত্ত্বিক প্রতর্কের বাইরে আর এক যে কমলকুমার তাঁরই পরিচয় আইকম বাইকম (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০.০০)। এই কমলকুমার সম্পর্কে নরেশ গুহ লিখেছেন, ‘এক সকালে পাটভাঙা খদ্দর পাঞ্জাবি পরা, ময়লা রং, স্বাস্থ্যবান, উঁচু লম্বা দেখতে, উজ্জ্বল রসিক মুখরোচক এক ভদ্রলোককে দেখলাম আড্ডার টেবিলে বসে জাঁকিয়ে রসিকতা করছেন, আর ছোটো নরুণের মতো একটা যন্ত্র দিয়ে হাতের তালুতে লুকিয়ে রাখা একখণ্ড কাঠ খুঁড়ে খুঁড়ে তখনো মুখাবয়ব ধীরে ধীরে ফুটিয়ে তুলছেন।’ শিল্পী, বিশেষ করে গ্রন্থচিত্রণশিল্পী কমলকুমারের পরিচয় নতুন করে সযত্ন মুদ্রণে ধরা থাকল দুষ্প্রাপ্য ছড়াসংগ্রহটির পুনঃপ্রকাশে। প্রথম সংস্করণের বিন্যাস যথাসম্ভব বজায় রেখে এই প্রকাশ জরুরি ছিল।
বিষ্ণু দে, কমল চক্রবর্তী প্রমুখকে লেখা কমলকুমারের ৭৮টি চিঠির সংগ্রহ কমলকুমার মজুমদারের চিঠি (সংকলন ও সম্পাদনা প্রশান্ত মাজী ও গৌতম মণ্ডল, আদম)। অগ্রন্থিত কমলকুমার (সংকলন ও সম্পাদনা প্রশান্ত মাজী, অবভাস, ৮০.০০)-এও নানা নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র ও কবিতা। ‘দেওয়ান-ই-খাসের ঘুম’, ‘রামকৃষ্ণ উপাসক’ বা ‘সংগীত’-এর মতো কয়েকটি দুর্লভ প্রবন্ধ আছে এই সংকলনে। নানা প্রকাশনা থেকে হলেও শতবর্ষে ক্রমে কমলকুমার মজুমদারের রচনাবলি সম্পূর্ণতা পাচ্ছে, আশার কথা। |
|
|
|
|
|