পুস্তক পরিচয় ১...
সত্যিই কি তিনি ‘রহস্যপুরুষ’
কমলকুমার: সৃষ্টি বৈচিত্রের খোঁজে, সম্পাদনা: শুভ মুখোপাধ্যায়। প্রকাশ ভবন, ৪০০.০০
যামিনী রায়ের বাড়িতে বেলেতোড়ের মাটির পুতুল ‘বাঘের পিঠে মানুষ’ দেখে চলচ্চিত্র-পরিচালক রেনোয়া (‘রনোয়ার’) নাকি বলেছিলেন, ‘I wont be surprised if Komal were riding that tiger’। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী ও গদ্যকারের (১৯১৪-১৯৭৯) জন্মশতবর্ষের প্রাক্কালে এই নতুন সংকলন-গ্রন্থটি পড়তে পড়তে মনে হল কমলকুমার বাঘের পিঠেই চড়েছিলেন। বাঘটি সত্যি বাঘ, তিনিও কম বাঘারু নন।
কমলকুমার মজুমদারকে ঘিরে যে অজস্র মিথ, যার প্রায় প্রত্যেকটিই তিনি নিজে সচেতন ভাবে তৈরি করেছিলেন, তা তাঁর অস্তিত্ব নির্ধারণ করেছে। এই গালগল্পমুগ্ধ শহরে এই মিথটি নির্মাণ করতে এবং সেই মিথটির যোগ্য হতে তাঁকে অকল্পনীয় রকম কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।
এই বইটির সম্পাদক তাঁকে স্মরণ করাতে গিয়ে পুনর্বার সেই মিথটিকেই আশ্রয় করেছেন। তাঁর রচনার ঐতিহাসিক মূল্যায়নের চেয়ে এই গালগল্প কম মূল্যবান নয়, মনে করেছেন তিনি। ‘আবহমান বাংলার কমলকুমার অনুরাগীদের’ উৎসর্গ করা হলেও (আবহমান বাঙালি তাঁকে গ্রহণ করেনি, করার কথাও ছিল না) এলিটিস্ট পাঠক ছাড়া (তিনি প্রান্তিক এলিটিস্টও হতে পারেন) তাঁর কোনও অনুরাগী তৈরি হয়েছে কি না, হওয়া সম্ভব কি না, তা নিয়ে সিরিয়াস সমীক্ষা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই ব্যাপক তরলীকরণের মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ হত।
কিন্তু না, পূর্ণেন্দু পত্রী, অশ্রুকুমার সিকদার ও অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর তিনটি অন্তর্দৃষ্টিময় পাঠ এবং নবনীতা দেব সেনের বিখ্যাত নির্মোহ পর্যালোচনাটি বাদ দিলে কমলকুমার-মিথটিই এই গ্রন্থের উপজীব্য। বহুবার ব্যবহৃত এমন এলিট লেখক-তালিকা আধুনিক সাহিত্যের ক’জন পুরোধার ভাগ্যে জুটত জানি না। সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, পরিতোষ সেন, হরিসাধন দাশগুপ্ত, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়, অশোক মিত্র, লোকনাথ ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু পত্রী, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, শানু লাহিড়ী, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, অশ্রুকুমার সিকদার, রবি ঘোষ, নবনীতা দেব সেন...। প্রান্তবাসীজনকে, যেমন রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁর কমলকুমার, কলকাতা পিছুটানের ইতিহাস (আনন্দ পাবলিশার্স) সম্ভবত কমলকুমারকে নিয়ে একমাত্র তন্নিষ্ঠ আলোচনা-গ্রন্থ, বেমালুম বাদ দেওয়া হয়েছে। এই ৩৬৪ পৃষ্ঠার বইতে এক বারও তাঁর উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি, এমনকি গ্রন্থপঞ্জিতেও নয়, যা বিস্ময়কর ভাবে ১৯৯৭ সালে থেমে গেছে! ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি বইতে গ্রন্থপঞ্জিটি ষোলো বছর আগে কেন শেষ হবে এবং সে-বই শিক্ষিত সমাজে কেন পেশ করা হবে, তার সদুত্তর খোঁজা নিরর্থক। মিথটিকে অব্যাহত রাখতে পারলেই হল। একই কারণে ১৯৮৯ সালে লেখা সুবিমল মিশ্র-র ‘সিকি লেবু নিঙরালে তিতো হয়ে যায়’-কে এই সংকলনে স্থান দেওয়ার কথা ভাবাও হবে না!
কী সেই মিথ (সমূহ), যা তাঁকে কাল্ট ফিগারে পরিণত করতে চায়? কমলকুমার মজুমদার খাটের নীচে বসে ফরাসি শিখেছেন, চটের থলিতে ফরাসি বই বহন করেন, খালাসিটোলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদ্যপান করেন, অতঃপর কুলকুচি। ইটিন্ডা ঘাটের হাঁড়ি বা জালার ‘ভলাপচুয়াস রোটানডিটি’-র কথা ‘ফরাসি কায়দায়’ উচ্চারণ করেন (যা অসম্ভব), গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে শালপাতার ঠোঙায় নকুড়ের সন্দেশ নিয়ে গিয়ে রেনোয়া ও তাঁর স্ত্রীকে প্রণাম করে মাটিতে বসেন। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত যখন জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনিও মশাই সাহেব দেখতে ছুটলেন?’ তখন একটুও অপ্রতিভ না হয়ে কমলকুমার উত্তর দিয়েছেন, ‘যাবো না? কত বড় বাপের ছেলে গো!’ (পৃ ৩৬) ‘গ্যারি সোবার্সের লেট-কাটের মতো তাঁর টাইমিং’ (পৃ ৩৮)। কিন্তু হাঁপানি সারাচ্ছেন না, কারণ ‘সাফারিং-এর একটা গ্র্যাঞ্জার আছে’। এক মুটের প্রশ্ন শুনে (বাবু কেত্না বাজা হ্যায়?) র্যানকিন কিংবা হারমানের তৈরি স্যুট ছেড়ে এক দিনে ধুতি-পাঞ্জাবি ধরেন (পৃ ৩২), ফরাসি বইয়ের ভেতর টাকা রাখেন (পৃ ৯৮), চটের থলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে ট্রামবাসের টিকিট কাটেন (পৃ ১০০), বাবার সঙ্গে ছেলেবেলায় রেস্তোরাঁয় এক সাহেব-মেমকে তাদের টেবিল থেকে উঠে যেতে দেখে ইংরাজি না শেখার সিদ্ধান্ত নেন...।
বলা বাহুল্য, যে সংস্কৃতিতে গালগল্পই প্রধান এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একমাত্র উপাদান, সেখানে এ-সব কাহিনি তাঁকে পুরাণে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করেছে। সম্পাদক লিখেছেন, ‘বাংলার সাংস্কৃতিক বৃত্তে একমাত্র রহস্যপুরুষ তিনি।’ সম্পাদকীয়তে এও জানানো হয়েছে, ‘জঁ রেনোয়া বলেছিলেন কমলকুমার সদৃশ ব্যক্তিত্বদীপ্র ও গুণধর মানুষ বঙ্গভূমিতে তিনি আর দ্বিতীয়টি দেখেননি’! একমাত্র রহস্যপুরুষ? কমলকুমার মজুমদার?
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকে নিয়ে মিথ-নির্মাণে শেষ হচ্ছে না কমলবৃত্তান্ত। তিনি নিজেও আপ্রাণ চেষ্টা করছেন একটি মিথ নির্মাণের। চটের থলি ও ফরাসি বই এই নির্মাণকে বুঝতে সাহায্য করছে, যা তৈরি করছে এক কৌতূহলজনক লিটরারি কন্সট্রাক্ট। এ এক অসম্ভব প্রবন্ধ।
পুরনো বাংলা গদ্যের উৎসে ফিরে যাওয়াকে আত্মানুসন্ধানের রাস্তা বলে মনে করেছিলেন তিনি, আমরা জানি। ‘দিনের পর দিন রক্ত জল করে যেটা আমি জেনেছি, যেটা আমি শিখেছি...,’ সেই গদ্যই গভীর জঙ্গলের অভ্যন্তরে চন্দনগাছ। কিন্তু কোন গদ্য? যে গদ্য চিত্ররূপময়, যে গদ্য স্থাপত্যের মতো। তাঁর মনে হয়েছিল ইংরেজির পদবিন্যাসের নানা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত না করলে প্রকৃত অভিজ্ঞান সম্ভব নয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ ও ‘কপালকুণ্ডলা’ থেকে ‘কমলাকান্ত’ ও ‘মুচিরাম গুড়ের জীবনচরিত’ পর্যন্ত, বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যের যে ব্যাপ্তি ও বিস্তার, তা কমলকুমারের গদ্যে মিলবে না। তাঁর গদ্যের সঙ্গে উনিশ শতকের নবোদ্ভাসিত আড়ষ্ট মিশনারি গদ্যের মিল খুঁজে পাবেন কেউ কেউ। কমলকুমার বলেছেন, ‘ফজল হয় ভালো লোক’ অপ্রচলিত নয়, ‘এ-ধরনের পদবিন্যাস এক কালে ছিল।’(পৃ ৫২) এটি নাকি ‘ব্রাহ্মণ্য যুগের ভাষা’। অর্থাৎ, তিনি নিজেই অবস্থান খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁর নির্মাণের।
‘জগজনচিতচোর মাধব’ ও শ্রীরামকৃষ্ণকে চার বার স্মরণ করলেও তাঁদের অমিল অপ্রকট নয়, তিনি কোনও থিওলজি তৈরি করতে পারেননি। এক বিচিত্র পরস্পর বিরোধিতাময় গোঁড়া হিঁদুয়ানি তার আত্মরক্ষার কবচ হয়ে উঠেছে। যেমন হয়েছে ফরাসি সাহিত্যে তাঁর তথাকথিত অবগাহন। প্রাক-ঔপনিবেশিক পদবিন্যাস (তর্কের খাতিরে ধরা যাক এক কল্পিত ব্রাহ্মণ্য যুগেরই) এবং মার্সেল প্রুস্তের সমন্বয়-প্রচেষ্টার মতো অপ্রত্যাশিত আর কী আছে? ভেতরে ভেতরে তৈরি হয় এক সাংঘাতিক অন্তঃচাপ। তবু এই অপ্রত্যাশিতকে এক অনিঃশেষ মায়ায় রূপ দিতে চেয়েছেন তিনি।
প্রুস্ত যে এক-আকাশ রামধনু-রঙ আবিষ্কার করেছিলেন ভাষা’কে ছোটবড় জলধারার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করে দিয়ে, কমলকুমারও তাই করতে চেয়েছেন প্রুস্তীয় ঢঙে, ফরাসি ‘gerund’ আর ‘present participle’-এর নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কালোয়াতি করে। কিন্তু ফরাসি ব্যাকরণ যাকে অবলীলায় শরীরে ধারণ করতে পারে, বাংলা তা পারে না। ফরাসি ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রুস্ত একটিও কঠিন শব্দ ব্যবহার করেন না। সে দিক থেকে কমলকুমার বিশেষ ভাবে অ-প্রুস্তীয় এবং অ-ফরাসি। ‘যা স্বচ্ছ নয়, তা ফরাসি নয়’। এই ফরাসি প্রবচন তিনি মনে রাখেননি। এখানেও তিনি একটি মিথ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর নিবিষ্ট, নির্জন কাঠখোদাই করা ভাষা যে সমুদ্র ছেঁচে অরূপরতন তুলে আনতে পারে, তা দীক্ষিত পাঠক মাত্রেই জানেন। সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী খোদাইচিত্র প্রতিটি ছোটগল্পে ও উপন্যাসে আলাদা। পূর্ণেন্দু পত্রী একে একটি চিত্রপ্রদর্শনীর সঙ্গে তুলনা করেছেন, যাতে আছে জলরঙ, পেন্টিং, ভাস্কর্য, ফ্রেস্কো, ক্যালিগ্রাফি, কারুশিল্প (পৃ ১৫২)।
এই চিত্রিত নির্মাণের দু-চারটি উদাহরণ না দিলে ইতিহাসের অপলাপ হবে। ‘ফজল ঠিক কালির বোতলের মতো।’ ‘রমণীগণ চকিত হইলেন, বাঁশুলী নয়ন কালিঘাট হইল।’ ‘এ ঘুমটার চেহারা অনেকটা নব্য ধারার শিল্পসাধনার এ্যাবস্ট্রাক্ট প্রজ্ঞানের মতো সুঠাম।’ ‘এ কারণে সৌন্দর্যবতী বালিকার ওষ্ঠে সূক্ষ্মকম্পন, নাসা স্ফীত, ক্রমে ধীরে আস্তে আস্তে তাহারই উন্নত সৌখিন গ্রীবা শিল্পীসমাজে আরাধিত রসিকজন সমাদৃত যথার্থ সুলিখিত বিচিত্র বক্ররেখা।’ ‘এখন ঘোড়াযুক্ত গাড়িখানি যাওয়া হেতু ছত্রকটি খোয়া শীর্ষ ভাঙিয়া চূর্ণীকৃত লাল।’
আর সাহস? ‘অন্তর্জলী-যাত্রা’-র কথা ছেড়েই দিলাম, ‘মল্লিকা বাহার’-এর মতো সাবলীল নারী সমকামের গল্প পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় তিনি কী করে লিখেছিলেন জানি না। কমলকুমারের জলরঙ স্কেচ, কাঠখোদাইগুলির আর্টপ্লেট এই বইটির সম্পদ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.