প্রবাসী, ভারতবর্ষের ছবি দেখে তৈরি প্রতিমার পুজো
রাসের প্রতিমায় উঠে আসে প্রবাসী বা ভারতবর্ষের মতো অধুনালুপ্ত সে কালের বিখ্যাত পত্রিকার নানা ছবির প্রতিফলনও। নবদ্বীপের রাধাবাজারের বিখ্যাত মহিষমর্দিনী প্রতিমা যেমন তৈরি হয়েছে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত মহিষমর্দিনীর ছবির মতো। এই প্রতিমার গাত্রবর্ণ সাধারণ ভাবে দুর্গার মতো নয়। তিসি ফুলের রঙে। সে কারণে এই দেবীর ধ্যানমন্ত্রেও সামান্য পরিবর্তন করতে হয়েছে। আঠারো হাতের নবদুর্গাও সে কালের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত ছবির মতো করেই তৈরি। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “পুজো উদ্যোক্তারা স্বকীয়তা আনা জন্য সাধারণ ভাবে যে সব দুর্গা বা কালী প্রতিমা তৈরি হয়, তার বাইরে গিয়ে কিছু করার কথা ভেবেছিলেন। সেই জন্যই তাঁরা প্রবাসী বা ভারতবর্ষের মতো বিখ্যাত পত্রিকায় প্রকাশিত নানা শিল্পীর আঁকা ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কোথাও হুবহু সেই ছবির মতোই প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে।” এখনও তা স্বমহিমায় রয়েছে।
সে কালের সেই প্রতিমা এখনও রয়ে গিয়েছে, কিন্তু জৌলুস অনেক বেড়েছে রাসের। পরিবর্তন ঘটেছে রাসোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন আচারেরও। সময়টা ১৯৫০-এর আশপাশে। তখন নবদ্বীপের রাস মানেই ‘আড়ং’ এর দিন অবধারিত মারামারি। সারা বছরের যার যা রাগ তা মেটানো হত রাসের সময়েই। আর সেখানে কথা বলত ‘খেটে’ নামের এক ধরণের ছোট বাঁশের লাঠি। শোভাযাত্রার প্রতিটি প্রতিমার পিছনে লুকনো থাকত ওই খেটে। তারপর সময় সুযোগ বুঝে তা দিয়েই ঘটে যেত রক্তারক্তি কাণ্ড।
নবদ্বীপের মায়াপুরে রাসের মণ্ডপ। —নিজস্ব চিত্র।
নবদ্বীপের পুরপ্রধান তখন রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র বাগচি। তিনি সেবার ঠিক করলেন বদমেজাজি এই রাস বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? সেবার রাসের ‘আড়ং’ এর দিন নিজের পাড়ার প্রতিমার সঙ্গে বিসর্জনের শোভাযাত্রায় বের হলেন রায়বাহাদুর। পরনে ধাক্কা পাড়ের চওড়া কোঁচানো ধুতি, পাটভাঙা পাঞ্জাবি। হাতে একটা বিরাট সাদা বিলিতি তোয়ালে। শোভাযাত্রা শুরু হতেই প্রতিমার সামনে ঢোল সানাইয়ের সঙ্গে রায়বাহাদুরের সে কী নাচ! আর দু’হাতে মাথার উপরে তোলা সেই সাদা তোয়ালে। রায়বাহাদুরকে তোয়ালে হাতে ওইভাবে নাচতে দেখে তো সকলেই থ। মারামারি করা মাথায় উঠল। এরপরেই রায়বাহাদুরের ঘোষণা- এবার থেকে রাসে আর শক্ত লাঠি নয়। নরম তোয়ালের দিন শুরু হল।
রায়বাহাদুরের ওই গল্প বলে গেলেন নবদ্বীপের প্রবীণ বাসিন্দা কালিদাস রায়চৌধুরী। চশমার পুরু লেন্সের ভিতর দিয়ে মাঝেমধ্যেই চকচক করছিল বড় বড় চোখদুটো। প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী, কালিদাসবাবু বলেন, “১৯৪২ এর আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে ফরিদপুরের বাড়ি ছাড়তে হয়। সেই থেকেই নবদ্বীপে। তবে সে সময়ের রাসের সঙ্গে এখনকার রাসের দিন-রাতের ফারাক।”
তখনও বিদ্যুতের এমন বিপুল ব্যবহার শুরু হয়নি। ফলে সে কালের রাসের সবটাই দিনের বেলা হত। বদল ঘটেনি প্রতিমার উচ্চতায়। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব বলেন, “তখন আর্থ-সামাজিক অবস্থা আজকের মতো ছিল না। তাই সেকালের রাসে দু’ একটি বারোয়ারি ছাড়া অধিকাংশ পুজোতেই দৈন্যের ছাপ ছিল স্পষ্ট। একটা বড় প্রতিমা, তার চারপাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে মাথায় ত্রিপল বা চট চাপিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যেত মণ্ডপ। দিনের বেলা পুজো। ফলে রাতে একটা বা দুটো হ্যাজাক কিংবা ডে লাইট। কোনও মণ্ডপে একটা দুটো বৈদ্যুতিক বাল্বও জ্বলত। বিসর্জন হত দিনের বেলাতেই। কিছু প্রতিমা বেহারার কাঁধে যেত। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিমা যেত দু’ জোড়া গরুর গাড়ির চাকা দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ধরনের গাড়িতে।”
চন্দননগরের আলো, কলকাতার সেরা মণ্ডপ এবং লক্ষ লক্ষ টাকা বাজেটের আজকের রাস দেখে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগের রাসের ছবি কল্পনাও করা যাবে না। প্রবীণদের মতে, সেকালের থেকে আজকের রাস অনেক আধুনিক। দৃষ্টিনন্দনও বটে। তবে শব্দের তাণ্ডব একালের রাসে অনেক বেশি। ঢাক, ঢোল-সানাই বা ডগরের মতো বাজনা সেকালের রাসকে অনেক বেশি সুরেলা করেছিল। সম্পন্ন বারোয়ারিরা আনতেন কলকাতা থেকে ইংলিশ ব্যান্ড। সংস্কৃতের প্রবীণ পণ্ডিত শুভেন্দু কুমার সিদ্ধান্ত বলেন, “কৃষ্ণচন্দ্রের আগে নবদ্বীপের বৈষ্ণবেরা যে রাস পালন করতেন তার সঙ্গে আজকের রাসের মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। রাজার অনুগ্রহে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা শক্তিমূর্তি গড়িয়ে রাসপূর্ণিমা তিথিতে পুজো শুরু করেন। যে কারণে নবদ্বীপের রাসকে কেউ কেউ শাক্তরাস বলেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র এই মূর্তি পুজোর জন্য ব্রাহ্মণদের আর্থিক সহায়তা করতেন। দেওয়া হত সম্মান দক্ষিণাও। পরবর্তীকালে এই পারিবারিক প্রতিমাগুলোই বারোয়ারি পুজোয় রূপান্তরিত হয়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.