“একবার উত্তর বাংলা আসিয়া যান, আমার জায়গা খান দেখিয়া যান, মনের কথা শুনিয়া যান রে।” উত্তরবঙ্গে কোনও সরকারি অনুষ্ঠানেই শোনা যায় ভাওয়াইয়ার সুরে এই গান। বাম সরকার চলে গিয়ে তৃণমূল সরকার এলেও তার বদল হয়নি। অথচ প্রবল জনপ্রিয় এই গানটির রচয়িতা, সরকারি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী ধনেশ্বর রায় দিন কাটাচ্ছেন চরম অর্থ সংকটের মধ্যেই। মাস খানেক ধরে অসুস্থ ওই শিল্পীর পাশে রাজ্য সরকার দাঁড়াচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত এক দশক ধরে এই গানটি উত্তরবঙ্গে লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। ভাওয়াইয়া শিল্পীরা কোনও অনুষ্ঠানে এই গান না গাইলে যেন কিছু একটা অধরা থেকে যায় শ্রোতাদের মধ্যে। ভাওয়াইয়া শিল্পী তথা জলপাইগুড়ির কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা বলেন, “ধনেশ্বরবাবুর রচিত গানটি কালজয়ী গানে পরিণত হবে। সমস্ত শিল্পীরাই তাঁর ওই গানটি গেয়ে থাকেন। ওই একটি গানের মধ্যেই গোটা উত্তরবঙ্গের পর্যটন চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এই গানের ভূমিকা অতুলনীয়।”
সেই গানের ‘কারিগর’ ধনেশ্বর রায় মাসখানেক ধরেই অসুস্থ। দু’সপ্তাহ উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ছিলেন। কিছুদিন আগে তাঁকে বাড়ি এনেছেন পরিজনেরা। ফালাকাটা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে জটেশ্বর ১ পঞ্চায়েতের আলিনগর গ্রামে বাড়ি। টিনের চালা দেওয়া তিনটি ঘর। এক ছেলে অন্য গ্রামে থাকেন। স্ত্রী ছাড়া তাঁর ছোট ছেলে ও তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে পরিবার। ৮০ বছর বয়সী ওই শিল্পী প্রায় শ’পাঁচেক গান লিখেছেন। তাঁর গানে ফিরে ফিরে এসেছে উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, মানুষজনের সুখ-দুঃখের কথা। |
অসুস্থ অশীতিপর ভাওয়াইয়া শিল্পী ধনেশ্বর রায়। ছবি: রাজকুমার মোদক। |
২০০৫ সালে রাজ্য সরকারের ভাওয়াইয়া শিল্পীদের জন্য ঠাকুর পঞ্চানন বর্মা পুরস্কার দিতে শুরু করে। সে বারই তিনি ওই পুরস্কার পান। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগ তাঁকে পুরস্কৃত করেছে। ২০০৫ সাল থেকে দেড় হাজার টাকা মাসিক ভাতা পেয়ে আসছেন তিনি। তবে তাও অনিয়মিত। দুই ছেলে আড়াই বিঘা জমি চাষাবাদ করে যা আয় করেন তা দিয়ে ছ’মাস চলে। বাকি সময় ওই শিল্পীকে পরিবার নিয়ে আধপেটা খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। চিকিৎসার খরচ সামলাতেই হিমসিম খেতে হচ্ছে গোটা পরিবারকে। ধনেশ্বরবাবুর কথায়, “উত্তরবঙ্গের শিল্পীদের জন্য ওই গানটি উৎসর্গ করেছি। বেশ কয়েকজন শিল্পী গানটি রেকর্ড করেছেন। আমি কোনও অনুষ্ঠানে গানটি গাই না। ভালবেসে প্রচুর গান রচনা করেছি। আমি যে পরিবার নিয়ে আর্থিক অনটনে ধুঁকছি, সে কথা সরকারের অনেক অফিসার বা বিধায়ককে বলে লাভ হয়নি। প্রায়ই আধ পেটা খেতে হয় পরিবারকে।”
ফালাকাটার বাসিন্দা তথা প্রাক্তন মন্ত্রী যোগেশ বর্মন সম্প্রতি অসুস্থ ধনেশ্বরবাবুর বাড়ি গিয়ে ধনেশ্বরবাবুর খোঁজ নিয়ে আসেন। যোগেশবাবুর কথায়, “ধনেশ্বরবাবুর গানটি উত্তরবঙ্গে পর্যটকদের টানতে খুব কাজে লেগেছে। ওই গানটি পর্যটন দফতরের থিম সং হওয়া উচিত ছিল। আমাদের আমলে তাঁকে ভাতা দেওয়া চালু হয়। তবে সে টাকার অঙ্কটা খুবই নগণ্য। তাঁর দিকে সরকারের বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া দরকার।” সুখবিলাসবাবুর আক্ষেপ, “উত্তরবঙ্গের নানা উৎসবের নামে যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দক্ষিণবঙ্গের শিল্পীদের জন্য খরচ হচ্ছে, তা যদি স্থানীয় শিল্পীরা পেতেন তবে তাঁরা উপকৃত হতেন।”
বিছানায় বসে অসুস্থ ধনেশ্বরবাবু আজও রেওয়াজ করেন। বললেন, “ভাওয়াইয়া শিল্পীদের দিকে সরকার সে ভাবে নজর না দেওয়ায়, অভাবের তাড়নায় অকালে বহু শিল্পী গান ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।” ধনেশ্বরবাবুর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও হাজার ছাড়িয়েছে। কয়েক জন বেশ নামডাকও করেছেন। ওই ছাত্রছাত্রীরা প্রতি বছর ধনেশ্বরবাবুর জন্মদিনও পালন করেন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে জন্মতিথিতে মঞ্চ তৈরি করে তাঁর গান ধনেশ্বরবাবুকে শোনান তাঁরা। ধনেশ্বরবাবুর কথায়, “এটাই আমার বড় প্রাপ্তি বলতে পারেন। ভাওয়াইয়া গানকে বিকৃত করে আজ বাজারে যো ভাবে সিডি বেরোচ্ছে তার আমি ঘোর বিরোধী। তা যাতে না করা হয় সেটাই ছাত্রছাত্রীদের বলি।”
ধনেশ্বরবাবুর ছোট ছেলে সুশীল রায় বাবার কাছে গানের তালিম নিয়ে এক সময় বেতারে অনুষ্ঠান করতেন। এক দশক হল তিনি গান ছেড়েছেন। তাঁর কথায়, “পেটে খিদে নিয়ে গান হয় না। ভাওয়াইয়া গান করলে খিদে মিটবে না বলে গান ছেড়ে জমির হাল ধরেছি। পরিবার সচ্ছল থাকলে বাবা আরও জনপ্রিয় গান রচনা করতেন।” ধনেশ্বরবাবুর আর্থিক সমস্যা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার কথা জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। তাঁর কথায়, “আমাকে ওঁর বিষয়ে কেউই কিছু জানাননি। খোঁজ নিয়ে যা করার করব। এই সরকার এর আগেও দুঃস্থ শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছে।” |