|
|
|
|
স্কুটার থেকে বিএমডব্লিউ, তবু জোড়হাত পরাগ
নিজস্ব সংবাদদাতা |
যেন সব্যসাচী! দু’ হাতেই তরতরিয়ে লিখতে পারেন!
বছর দশেক আগেও সকালের দিকে কলকাতা পুরসভার বারান্দায় সাফারি-স্যুট পরা যুবকটিকে হামেশা দেখা যেত। তিনি পরাগ মজমুদার, শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের তদন্তকারীরা বুধবার যাঁকে কলকাতা বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করে ফিরিয়ে এনেছেন, মুম্বই-যাত্রায় বাদ সেধে। ভবানীপুরের জাস্টিস দ্বারকানাথ রোডের ‘বলাইকুঠি’-র বাসিন্দা ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলেটি পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। পুরভবনে তখন আসতেন স্কুটারে চড়ে। পুর-অফিসাররা জানিয়েছেন, বছর তিনেক ধরে পরাগ আসছিলেন বিএমডব্লিউ গাড়িতে সওয়ার হয়ে।
গাড়ি পাল্টে গেলেও মানুষটা পাল্টাননি। “অত্যন্ত বিনয়ী, ঠান্ডা মাথার লোক। আচার-ব্যবহারে সহজে মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন। পরিচিত কাউকে দেখলে হাতজোড় করে নমস্কার করেন। বয়সে বড় হলে পায়ে হাত দেন।” বলছেন পুরসভার এক অফিসার। জানা গিয়েছে, পরাগ এ বছরেও দুর্গাপুজোর ছুটি শেষে পুরভবনে এসে একাধিক অফিসারকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন। |
|
|
কৌশিক |
পরাগ |
|
আর এ ভাবেই তিনি পুর-অফিসারদের একাংশকে হাতের মুঠোয় রেখেছিলেন। অন্তত পুরমহলের অন্দরে এমনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এক অফিসারের কথায়, “আইনি জটিলতায় আটকে থাকা জমি বিক্রির ব্যবস্থা করতে পরাগ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। খাতিরের অফিসারদের যোগসাজসে জমির নক্শা পাশ করানো ওঁর কাছে জলভাত।” শোনা যাচ্ছে, অনেক কাউন্সিলরের সঙ্গেও তাঁর দহরম-মহরম ছিল নজরকাড়া। পরাগের কাজকর্মের বিশেষত্ব কী ছিল?
পুরসভার এক ইঞ্জিনিয়র জানান, কলকাতায় বহু ছোট-বড় জমির মালিকানা ঘিরে আইনি জটিলতা রয়েছে। পরাগ সে সবের খোঁজ রাখতেন। সময় বুঝে সমস্যা মেটাতেন ‘নিজের মতো’ করে। “ও চার আনায় জমি কিনে, সব খরচাখরচ মিটিয়ে এক টাকায় বেচত। এ জন্য ক্ষমতাবান লোকজনকে মুঠোয় রাখা দরকার হতো।” বলেন পরাগেরই এক বন্ধু। পুলিশের অভিযোগ: ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমির জটিলতার সমাধানে বাউন্সার নিয়োগকারীদের মধ্যে পরাগও ছিলেন। এক গোয়েন্দা-কর্তার কথায়, “সোজা আঙুলে ঘি না-উঠলে পরাগ যে অন্য রাস্তায় যেতে পিছপা হতেন না, শর্ট স্ট্রিটই তার প্রমাণ।”
পুলিশ-সূত্রের খবর: ২০০৫ নাগাদ পরাগ পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে গঙ্গাপ্রসাদ রোডে চলে যান। পুরসভা ও পুলিশের একাংশের সাহায্যে ২০০৬ নাগাদ জোরদার কারবারে নামেন। ২০০৯-এ তাঁর পরিচয় হয় কৌশিক সেন নামে এক তরুণ কংগ্রেস নেতার সঙ্গে। কৌশিক সম্প্রতি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। দলীয় সূত্রের খবর, তৃণমূলের এক প্রভাবশালী নেতার আত্মীয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। শর্ট স্ট্রিট-কাণ্ডের প্রেক্ষাপটে কৌশিক-পরাগের সম্পর্কও পুলিশ খতিয়ে দেখছে। কৌশিকবাবু বৃহস্পতিবার বলেন, “পরাগের সংস্থায় আমি সরাসরি কাজ করতাম না ঠিকই। তবে ওঁর সঙ্গে আমার একটা ব্যবসায়িক লেনদেন ছিল।” কী সেই লেনদেন?
পুলিশ ও স্থানীয়-সূত্রের খবর, কোনও জমি বা ভাড়াটে নিয়ে পরাগের সমস্যা হলে কৌশিকবাবু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কৌশিকবাবুর ব্যাখ্যা, “ছোটখাটো ঠিকাদার হওয়ার সুবাদে অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাই পরিচিত ভাড়াটেদের সঙ্গে পরাগের রফা করিয়ে দিতাম। কমিশনও পেতাম।”
তা হলে শর্ট স্ট্রিটের জমি-কাণ্ডেও কি তিনি যুক্ত ছিলেন?
কৌশিকবাবু বলেন, “এ ব্যাপারে কিছু জানি না। পরাগ আমাকে বলেনি যে, সে ওখানে জড়িত। তবে ৯বি এবং ৯সি শর্ট স্ট্রিটের জমি নিয়ে রতনলাল (নাহাটা) ও মমতার (অগ্রবাল) সঙ্গে আমার বিবাদ ছিল।” কী বিবাদ?
কৌশিকবাবু জানাচ্ছেন, ৯বি ও ৯সি-র জমি দু’টি এই মুহূর্তে লি রোডের এক ব্যক্তির হাতে। তাঁদের সঙ্গে পরাগের সুসম্পর্ক ছিল। মাস সাতেক আগে ওখানকার চারটি ঘর থেকে ভাড়াটে উঠে যায়। কৌশিকবাবুর দাবি, তখন পরাগের দেওয়া ‘অথরিটি লেটার’ নিয়ে তিনি সেগুলি মেরামতি শুরু করেছিলেন, কিন্তু মমতা তাঁকে কাজ বন্ধ করার হুমকি দেন। এ বিষয়ে তিনি শেক্সপিয়র সরণি থানায় মমতা ও রতনলালের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। পরে ১৪৪ ধারা জারি করে ফের কাজ শুরু হয়। কৌশিকবাবুর অভিযোগ, তখনও মমতা বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দেন। এর পরে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১০৭ ধারায় মমতার বিরুদ্ধে ফের অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
কিন্তু পরাগ ওই জমির ঘর মেরামতির ‘অথরিটি’ দেওয়ার ক্ষমতা পেলেন কোথা থেকে?
কৌশিকবাবুর বক্তব্য, এ সম্পর্কে তিনি অন্ধকারে। কিন্তু সোমবার শর্ট স্ট্রিটে গুলিচালনার ঘটনার পরে বেশ ক’বার পরাগের সঙ্গে তো তাঁর ফোনালাপ হয়েছিল? কী নিয়ে?
কৌশিকবাবুর ব্যাখ্যা, “ওই দিন সকালে টিভি-তে খবর দেখে ঘটনাটি জানতে পারি। নিজের নাম জড়ানোয় অবাক হয়ে পরাগকে ফোন করেছিলাম। এ নিয়েই বার বার কথা হচ্ছিল। ও বলছিল, মমতা পুরনো রাগ মেটাতেই আমাকে ফাঁসিয়েছে।”
|
পুরনো খবর: বিমানবন্দরে পাকড়াও পরাগ |
|
|
|
|
|