বিমানবন্দরে পাকড়াও পরাগ
সন বুক করাই ছিল। বুধবার দুপুর সওয়া তিনটে নাগাদ বিমানবন্দরে পৌঁছেও গিয়েছিলেন। জেট বিমানসংস্থার চেক ইন কাউন্টারে গিয়ে নামটা বলতেই সামনে এসে দাঁড়াল সিআইএসএফ।
“আমায় কেন আটকানো হচ্ছে?”
জবাব এল, “সে তো আপনি নিজেই জানেন!”
মুম্বই পালানোর মুখে এ ভাবেই ধরা পড়ে গেলেন পরাগ মজমুদার।
তিন বছর আগে ৯এ শর্ট স্ট্রিটের জমিটি ব্যবসায়ী সঞ্জয় সুরেখাকে কিনিয়ে দেওয়ার পিছনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন এই পরাগ। ১৯৯৯ সালে শৈলবালা সেন যখন জমিটি মুম্বইয়ের হার্টলাইন সংস্থাকে বিক্রি করেন, তখনও পরাগ জড়িত ছিলেন। এবং সুরেখার দাবি অনুযায়ী, জমি খালি করে সুরেখার হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্বও পরাগেরই ছিল।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ এ দিন বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, ওই বাড়িতে বহিরাগতদের নিয়ে হামলা চালানোর পিছনে পরাগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।” সোমবারই হামলাকারীদের নেতৃত্বে থাকা পার্থ চট্টোপাধ্যায় নামে এক আইনজীবীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সম্পত্তি-ব্যবসায়ী পার্থ যে পরাগ মজমুদারের ঘনিষ্ঠ, সে কথা গোয়েন্দারা গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন। পার্থকে জেরা করেই পরাগের নাম শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডে সামনে এসেছে বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর। মমতা অগ্রবালও তাঁর অভিযোগে পরাগের নাম করেছিলেন।
পরাগ যে মুম্বই পালানোর ছক করছেন, তা আগেই জানতে পেরেছিল পুলিশ। সেই মতো বিমানবন্দরে সিআইএসএফকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। গ্রেফতারের পর রাতে পরাগকে শেক্সপিয়র সরণি থানায় আনা হয়।
চলছে ফরেন্সিক দলের তদন্ত। বুধবার ৯এ শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
পুলিশের দাবি, পরাগ মজমুদার ওই হামলার অন্যতম প্রধান কুশীলব। কয়েক মাস আগে থেকেই জমিটি কী ভাবে দখল করা যায়, তার পরিকল্পনা করছিলেন পরাগ। জমি কেনার তিন বছর পরেও তার দখল পাননি সঞ্জয় সুরেখা। পুলিশের মতে, সঞ্জয় সম্ভবত এ নিয়ে পরাগকে চাপ দিয়ে থাকবেন। জমির দখল নিতে চাপে ছিলেন হার্টলাইন এস্টেটের কর্ণধার দিলীপ দাসও। মাস দুয়েক আগে ওই বাড়ির দেওয়ালে একটি নোটিস লটকানো হয়। নোটিসে জমির মালিক হিসেবে নাম ছিল হার্টলাইনেরই। গোয়েন্দাদের দাবি, শেষ পর্যন্ত যেনতেন প্রকারে জমিটি দখল করাই পরাগদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। সে জন্য এক প্রোমোটারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরাগ। ওই প্রোমোটারকে পুলিশ খুঁজছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই প্রোমোটারই জমিটি দখল করার জন্য পার্থ এবং নিরাপত্তা সংস্থার কর্ণধার অরূপকে কাজে লাগান। পার্থ ও অরূপকে বলা হয়, কাজ হাসিল করতে পারলে মোটা টাকা দেওয়া হবে। সেই মোতাবেক অরূপ ১৮ জন রক্ষীকে দখল অভিযানের জন্য নিয়োগ করেন। দখলের পরে জমি পাহারা দেওয়ার জন্য ১০ জন নিরাপত্তারক্ষী রাখা হবে বলে ঠিক হয়েছিল। তবে কে অরূপকে টাকা দিয়েছিল, সেটা জানার চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।
ঘটনার ঠিক পরেই অরূপকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জেনেছিল, তিনি সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু সেখানে খোঁজ করে অরূপের হদিস মেলেনি। বারুইপুরে তাঁর একটি অফিস রয়েছে বলে পুলিশকে জানান অরূপবাবু। কিন্তু বারুইপুরেও তাঁর কোনও অফিসের হদিস পাওয়া যায়নি বলে পুলিশি সূত্রে খবর। ইতিমধ্যে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছেন অরূপ।
তবে তদন্তকারীরা জেনেছেন, পার্থ ও অরূপের যোগাযোগ ছিল। সাউথ গড়িয়ার পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাড়ায় পার্থ-উকিল নামে সবাই এক ডাকে চেনেন। জরুরি কাজ রয়েছে বলে রবিবার সন্ধ্যায় স্ত্রী স্নেহাকে জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন পার্থ। সোমবার সকাল থেকে মোবাইল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, পার্থ দাবি করেছেন, রতনলাল নাহাটার ঘনিষ্ঠ ফারহান নামে এক যুবক ঘটনার কিছু দিন আগে জমি দখলের ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তার সঙ্গেই পরামর্শ করে ঠিক করা হয়, সোমবার ভোরে ওই সম্পত্তির দখল নিতে যাবেন পার্থ ও তার দলবল। ফারহান তাঁকে বলেছিল, ওখানে ঢুকলে কেউ বাধা দেবে না। রতনলাল ওই বিতর্কিত সম্পত্তি ছেড়ে দিতে রাজি। পার্থর দাবি, ফারহানের কথা বিশ্বাস করেই তিনি অরূপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা ভাবতেই পারেননি, মমতা গুলি চালাবেন। ঘটনার পর থেকেই পলাতক ফারহান। তার খোঁজ মিললেই ঘটনায় রতনলালের ভূমিকা স্পষ্ট হবে।
তবে পার্থর কথা শোনার পরে পুলিশের অনেকটাই নিশ্চিত যে, ইদানীং ওই জমি নিয়ে রতনলাল আর মমতার মধ্যে বিরোধ বেধেছিল। সে জন্য মমতাকে না জানিয়েই রতনলাল তাঁর ঘনিষ্ঠ ফারহানকে পার্থর সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলেন। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, ওই জমির উপর দাবি ছেড়ে দেওয়ার জন্য রতনলালের সঙ্গে পরাগের তিন কোটি টাকার রফা হয়েছিল। যার মধ্যে ৭৫ লক্ষ টাকা রতনলালকে পরাগ দিয়েও দিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
মমতা কি জানতেন রতনলালের ইচ্ছাতেই জমির দখল নেওয়া হবে? তদন্তকারীদের একাংশের অনুমান তেমনই। কিন্তু রতনলালের নাম করে অভিযোগ করলে তিনি নিজেও জড়িয়ে পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় পুলিশকে ঘটনার আগের দিন কিছু বলেননি। অথচ গত এক বছর যাবৎ মমতা বিভিন্ন মহলে একাধিক বার তাঁর উপর হামলা হতে পারে বলে নিরাপত্তার আর্জি জানিয়ে রাখছিলেন। এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ২০১২-র শেষ দিকে ওই বাড়িতে এক বার বহিরাগতরা হামলা চালিয়েছিল। তার পরে শেক্সপিয়র সরণি থানা থেকে রাতে ওই বাড়ির সামনে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়।
পরে পাহারা উঠে গেল কেন? পুলিশ সূত্রের খবর, মমতা যে সব অভিযোগ করেছিলেন, তদন্তে দেখা যায় তার বেশির ভাগই অসত্য। সর্ব ক্ষণের পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে মমতা আদালতে একটি রিট পিটিশন করেন। সেটিও খারিজ হয়ে যায়। তার পরে এ বছর অগস্ট মাসের মাঝামাঝি মমতা নিরাপত্তার অভাব জানিয়ে রাজ্যপালকে চিঠি লিখেছিলেন। রাজ্যপাল ওই চিঠি স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠিয়ে দেন। স্বরাষ্ট্র দফতরের জন-অভিযোগ বিভাগের যুগ্মসচিব সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি মমতাকে ডেকে তাঁর বক্তব্য শোনেন।
স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর, যুগ্মসচিবকে মমতা জানিয়েছিলেন, রতনলাল নাহাটা তাঁর আত্মীয়। সমাজবিরোধী এবং বহিরাগতরা তাঁর উপর হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি। যুগ্মসচিব এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশ কমিশনারকে চিঠি দেন।
বুধবার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় ছ’জন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের একটি দল। বাইরের দিকের ঘরের জানলার পাল্লা ঠেলে দেখা যায়, মাটিতে মাদুরের উপর নীল রঙের কম্বল দিয়ে তৈরি বিছানায় শুয়ে রয়েছেন এক বৃদ্ধ। সামনে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকায় মুখটা ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। তাঁর পরনে হলুদ গেঞ্জি ও আকাশি রঙের ফুল-ফুল ছাপ চাদর। গালে তিন-চার দিনের না-কাটা সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা জানান, তিনিই রতনলাল নাহাটা।

অষ্টরথী

মমতা অগ্রবাল

রতনলাল নাহাটা

সঞ্জয় সুরেখা

পরাগ মজমুদার

দিলীপ দাস

ফারহান

পার্থ চট্টোপাধ্যায়

অরূপ দেবনাথ
এঁদের মধ্যে অরূপ, পার্থ ও ফারহান সোমবারের ঘটনায় সরাসরি জড়িত বলে
পুলিশের সন্দেহ। পার্থকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ফারহান ও অরূপের খোঁজ চলছে।

পুরনো খবর:
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.