আর দেরি নয়। তিন বছরের মধ্যেই কলকাতার দরজায় এসে দাঁড়াবে শিল্পবিশ্ব।
বৃহস্পতিবার নিউটাউনে কলকাতা মিউজিয়ম অব মর্ডান আর্টের (কেমোমা) শিলান্যাসকে ঘিরে সেই স্বপ্ন সত্যি হতে দেখার দিন গোনা শুরু হল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, “বিশ্বমানের শিল্পকলা চাক্ষুষ করতে এ দেশের মানুষকে আর প্যারিস-ভেনিস দৌড়তে হবে না!” আধুনিক কলাশিল্পের ‘গ্রেট মাস্টার’দের কাজ এ বার কলকাতায় বসেই দেখার সুযোগ মিলবে। মমতার আশা, “কেমোমা দুনিয়ার মধ্যে মডার্ন আর্টের একটি সেরা মিউজিয়াম হবে। আমাদের গর্বিত করবে।”
শিল্পরসিকদের দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ছিল, কলকাতা দেশের শিল্প-সংস্কৃতির রাজধানী বলে চিহ্নিত হলেও স্বাধীনতার পরবর্তী ছ’দশকে শিল্পসংস্কৃতি চর্চার জন্য যথার্থ আন্তর্জাতিক মানের কোনও প্রতিষ্ঠান পায়নি। কলকাতা থেকে আন্তর্জাতিক মানের শিল্পপ্রতিভা জন্ম নিয়েছে। কিন্তু কলকাতা নিজে পাকেচক্রে বারবারই পরিকাঠামোর উৎকর্ষ বাড়ানোর দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছে।
আক্ষেপ ঘুচিয়ে গর্বের নতুন ঠিকানা হয়ে ওঠার শপথ নিয়েছে কেমোমা। তার হাত ধরেই যথার্থ আন্তর্জাতিক পরিচয়ের দিকে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে চলেছে কলকাতা। বিশ্বকে ঘরের মাটিতে নিয়ে আসার পাশাপাশি বিশ্বের দরবারে নিজেকে মেলে ধরা। কেমোমা-র ট্রাস্টির চেয়ারম্যান ব্রিজমোহন খেতান জানিয়েছেন, এই প্রতিষ্ঠানে শিল্পীরা নির্ভাবনায় সৃষ্টিতে মন দিতে পারবেন। তাঁদের কাজের প্রদর্শন আর বিপণনের দিকটা কেমোমা দেখবে।
কেমোমাকে ‘রাজ্যের ভবিষ্যৎ’ বলে অভিহিত করে মুখ্যমন্ত্রী তাই চাইছেন, কালক্ষেপ না করে জোরকদমে কাজ শুরু হোক। শিলান্যাস অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে এ দিন তাঁর স্পষ্ট বার্তা, “এত দিন যা সময় লাগার, লেগেছে। এ বার দ্রুত কাজ শুরু করে শুধুই সামনে হেঁটে চলা!” রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা মিশে গিয়েছে মমতার কথায়, এখন আর দেরি নয়, ধর গো তোরা, হাতে-হাতে ধর গো! |
তিন বছর আগে মমতার উপস্থিতিতেই টাউন হল-এ প্রকাশ পেয়েছিল কেমোমা-র চূড়ান্ত নকশা। তখন আশা করা গিয়েছিল, ২০১৪-র মধ্যেই সম্পূর্ণ হয়ে যাবে কাজ। কিন্তু নানা কারণে প্রকল্পটি পিছিয়ে যায়। মমতা এ দিন বলেন, “বড় কাজে সময় হয়তো লাগে। কিন্তু শুরু যখন হল, এ বার আর থামবেন না।”
মুখ্যমন্ত্রীর এই ইতিবাচক বার্তাটুকু যে কেমোমা-র বিকাশের পথে বিরাট পুঁজি, তা স্মরণ করতে ভোলেননি ট্রাস্টিরা। পাশে দাঁড়ানোর জন্য বারবার মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন কেমোমা-র চেয়ারম্যান ব্রিজমোহন খেতান, অন্যতম ট্রাস্টি যোগেন চৌধুরী এবং ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাখী সরকার। রাখীদেবীর কথায়, “কেমোমা-র স্বপ্ন সফল করার জন্য দু’টি দিক খুব জরুরি। বাংলার সাধারণ নাগরিকদের এই কর্মকাণ্ডের আয়োজনে সামিল করতে হবে। আর, মমতাদির স্বপ্ন-আবেগ-উদ্যম ছাড়া কিছুতেই কিছু হবে না!” নিউটাউনে রাজ্য সরকারেরই দেওয়া জমিতে দাঁড়িয়ে কেমোমা-র জন্য সব রকমের সহযোগিতা ও সমর্থনের আশ্বাসই দিয়েছেন মমতা।
বিমানবন্দর থেকে মাত্র দশ মিনিটের দূরত্বে নিউটাউনে রাজ্য সরকারের ইকো-ট্যুরিজম পার্কের কাছে কেমোমা-র জমি। খুব কাছেই চলবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো। এই অবস্থানের কথা বলতে বলতেই মমতা জানান, রেলমন্ত্রী থাকাকালীনই কেমোমা-র নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশনটির নাম তিনি ‘শিল্পতীর্থ’ বলে ঠিক করে দিয়েছেন। শিল্পের তীর্থই বটে। ইরাক বা ইরানের মরুভূমিতে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া, প্রাচীন স্তেপ পিরামিড বা ‘জিগগুরাত’ ধাঁচের স্থাপত্যের সঙ্গে আধুনিক ‘ব্লক বাই ব্লক’ প্যাটার্নের চতুষ্কোণ শৈলীর মিশেল। দশতলা বাড়ির বিভিন্ন তলে মোট ৪৪টি গ্যালারি। কোনও গ্যালারি উনিশ শতক থেকে আজকের ভারতীয় চিত্রকলার জন্য। কোনওটি ইউরোপ, আমেরিকা, চিন বা জাপানের শিল্পের জন্য। প্রতিটি তলের কার্নিসে মুঘল রীতির জাফরির কাজ।
কেমোমা-র এই নকশা তৈরি করেছে গোটা বিশ্বের সমীহ কুড়োনো সুইস স্থপতি সংস্থা ‘এরজোগ & দ্য মেরোন’। ‘এরজোগ & দ্য মেরোন’ এর আগে বেজিং-এর বিখ্যাত পাখির বাসা স্টেডিয়াম বা লন্ডনের টেট মডার্ন গ্যালারি বানিয়েছিল। শিল্পরসিকরা আশা করছেন, কেমোমা অদূর ভবিষ্যতে কলকাতার টেট মডার্ন বা কলকাতার মোমা হিসেবে বিশ্ব দরবারে জায়গা করে নেবে।
নিজেকে সগর্বে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের উত্তরসূরি বলে অভিহিত করে শর্মিলা ঠাকুর বললেন, “অবনীন্দ্রনাথের সময় থেকেই ভারতে যে আধুনিক শিল্পকলার সূচনা হয়েছিল, তার এগিয়ে চলার ইতিহাস আজও সংকলিত হয়নি। তাই এমন একটি সিরিয়াস মিউজিয়াম খুব জরুরি ছিল।” ব্রিটিশ ভাস্কর স্টিফেন কক্স বলেন, “ভারতের তিন হাজার বছরের শিল্পকলার অভিজ্ঞতার উপরে ভর করেই এ এক নতুন শুরু বাংলার!”
শুধু এ দেশের শিল্পচর্চার ইতিহাস নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্ট অ্যাকাডেমির স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্যক্রমের তালিমও মিলবে কেমোমা-য়। শিল্পের ইতিহাস, সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত চর্চায় সমৃদ্ধ আর্কাইভ গড়ে তোলা হবে এই প্রতিষ্ঠানে। শিল্পকলার ইতিহাস ও সংরক্ষণ-বিষয়ক চর্চার বিশিষ্ট কেন্দ্র লন্ডনের কুর্টোল্ড ইনস্টিটিউট অফ আর্ট-এর সঙ্গে মাঝেমধ্যেই গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করবে কেমোমা। প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিকতাবোধের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপদেষ্টামণ্ডলীতে দেশ-বিদেশের নামজাদা শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সংগ্রহালয়ের পণ্ডিতদের ছড়াছড়ি। প্যারিসের একোল নাসিওনাল সুপেরিওরের প্রাক্তন অধ্যাপক কিংবা সিঙ্গাপুর আর্ট মিউজিয়মের শিক্ষকেরা অনেকেই এই তালিকায় রয়েছেন।
নতুন শুরু তো বটেই। অনুষ্ঠানে উপস্থিত কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছিল, বছর কয়েক আগের কথা। সিমা গ্যালারিতে আধুনিক জার্মান শিল্পের একটি প্রদর্শনী চলছিল। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সেটা দেখতে দেখতে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আর ক’দিন পরেই পিকাসো-র একটি প্রদর্শনী আসছে। দিল্লি, মুম্বইয়ে আসবে। কলকাতা আনতে পারে না?” তাঁকে জানানো হয়েছিল, ওই পর্যায়ের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আয়োজন করার মতো গ্যালারি কলকাতায় নেই।
কিন্তু ভাবনাটা ওই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল। তারই ফসল কেমোমা। কলকাতায় বসে পিকাসো দেখার দিন আর হয়তো খুব বেশি দূরে নেই!
|