|
|
|
|
প্রিয় ছাত্রের কাছে সেঞ্চুরি গুরুদক্ষিণা চাইলেন আচরেকর
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায় • মুম্বই |
ইডেন টেস্ট দেখেছেন?
উঁ।
সচিনকে তো ভুল আউট দিল।
উত্তেজিত ঠোঁট কয়েক বার কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি নিথর।
ওয়াংখেড়ে যাবেন?
চোখ বিস্ফারিত। মাথাটা প্রবল বেগে উপরে-নীচ করে কিছু বলতে চাইল, পারল না।
সচিনের কাছে কিছু চাইলেন?
ঘরঘর শব্দে কিছু বলার আবার ব্যর্থ চেষ্টা। ব্যস, তারপর সে চেষ্টাও থেমে গেল।
কত দৈর্ঘ্য হবে একচিলতে ঘরটার? বড়জোর দশ ফুট বাই দশ ফুট। টিভিতে প্রিয় ছাত্রের অন্তিম টেস্টের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, এককোণের ডিভানে এলিয়ে থাকা অশীতিপরের পিঠ টান হল একটু। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চব্বিশ ঘণ্টার অ্যাটেনডেন্টের তখন স্বগতোক্তি শুরু, “এই তো চলছে সারা দিন। হয় কমেডি সিরিয়াল, নইলে যখন যেখানে সচিন...।”
মুখ চেনা হোক কিংবা অর্ধপরিচিত, গেট পেরিয়ে ঢুকলে স্বাভাবিক শিষ্টাচারে মাথাটা এখনও আনন্দে অল্প অল্প দোলে। শুধু অতি পরিচিত টুপিটা কাউকে পরিয়ে দিতে হয়। ঠোঁট তার ভাষা হারিয়েছে বহু দিন। গলা দিয়ে জান্তব কিছু আওয়াজ ছাড়া কিছু বেরোয় না। রমাকান্ত আচরেকর আর রুটির টুকরো ছিঁড়তে পারেন না। চামচে করে যতটুকু যা খাওয়া যায়, ততটুকু। ডান দিকটা অসাড়। মাঝে পড়ে গিয়ে হাঁটাচলাও বন্ধ প্রায় বছর চারেক।
তবু তো দ্রোণাচার্যর দোর্দণ্ডপ্রতাপ আজও কমল না! |
ইডেনে টেস্টের রেকর্ডিংয়ে মজে সচিন-গুরু। |
কণ্ঠস্বর বিদ্রোহ করেছে ঠিকই। কিন্তু চোখের দৃষ্টি, শরীরী ভাষা বোধহয় এখনও যথেষ্ট। যেখানে রাগ-দুঃখ-অভিমান নির্দ্বিধায় ঘোরাফেরা করে সময়-সময়, বিখ্যাত-অখ্যাত নির্বিশেষে যা দরকারে ধমক দেয় ছাত্রদের, প্রয়োজনে চেয়ে নেয় গুরুদক্ষিণা।
সচিন রমেশ তেন্ডুলকরকেও তো বিদায়ীলগ্নে গুরুর কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকে যেতে হল!
বৃহস্পতিবার থেকে গোটা দেশ যা চাইবে মরাঠির কাছে, আচরেকরও সেটা চেয়ে রেখেছেন তাঁর থেকে।
বিদায়ী টেস্টে একটা সেঞ্চুরি!
শোনা গেল, সচিনের অবসর নিয়ে নাকি খুব একটা খুশি ছিলেন না আচরেকর। সিদ্ধান্ত নিয়ে গুরুকে যখন খবরটা শিবাজি পার্কের বাড়িতে দিতে এসেছিলেন সচিন, আচরকেরকে কিছুটা নাকি মনঃক্ষুণ্ণই দেখিয়েছিল। তাঁর ক্রিকেটার-কন্যা কল্পনাই কথাগুলো বলছিলেন। আচরকের চাইছিলেন, আরও দু’টো বছর খেলুন সচিন। তার পর অবসর নিলে ঠিক আছে। “বাবাকে রাগ করতে দেখে সচিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এখনই না নিলে নয়? সচিন বলল, ওর আর কিছু পড়ে নেই। বিশ্বকাপ জিতেছে। সব রেকর্ডও হয়ে গিয়েছে। এক দিক থেকে ঠিক,” আনন্দবাজারকে এ দিন বলছিলেন কল্পনা আচরেকর। যিনি এখন শিবাজী পার্কে প্রখ্যাত পিতার কোচিং ক্যাম্প চালান। যাঁর ছেলে বর্তমানে ক্রিকেট খেলে। বছর আঠারোর বৈদিক মুরকর মাঠে ছোটার আগে বলেও গেলেন, “সচিনকে সে দিনই দাদু আকারে-ইঙ্গিতে বলে দিয়েছে যে, ওয়াংখেড়েতে একটা সেঞ্চুরি করতে হবে। ম্যাচে তো দাদু যাবে বলছে।”
এবং গুরু-শিষ্যের এমন সম্পর্কের উপাখ্যান একটা নয়। বহু আছে। কোনওটা ছড়িয়ে পেরি ক্রস রোডে সচিনের নতুন বাংলোয়। কোনওটা সারদাশ্রম স্কুলের চার দেওয়ালে।
নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশের দিনে তো বটেই, শোনা গেল গত গণেশ পুজোর দিন আচরেকরকে সপরিবার নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন সচিন। বলেও দেন, “এটা আপনারই বাড়ি। যখন খুশি আসবেন, যত দিন ইচ্ছে থাকবেন।” বাকরুদ্ধ আচরেকরকে সে দিন নাকি বিহ্বল দেখিয়েছিল। এটা সাম্প্রতিকের হলে, অতীতের কিছু কিছু আরও রোমাঞ্চকর।
স্রেফ ক্রিকেটের জন্য বান্দ্রার স্কুল ছেড়ে সারদাশ্রমে ঢুকেছিলেন সচিন। যেখানে হেড কোচ ছিলেন আচরেকর। সেটা ১৯৮৪ সাল। যে বছরই কিশোর সচিনকে কাঙ্গা লিগের জি ডিভিশন টিম জন ব্রাইট ক্রিকেট ক্লাবে ঢুকিয়ে দেন আচরেকর। তবে ক্লাব কর্তাদের নাকি একই সঙ্গে বলেও রাখেন, এখন নিচ্ছ। কিন্তু এটাও জেনো যে, এই ছেলে এক বছরের বেশি তোমাদের ক্লাবে থাকবে না। জি ডিভিশনের জন্য এ আসেনি! শোনা গেল, হিরে চিনেছিলেন বলেই আচরেকর দিনে পাঁচ বার নেট প্র্যাকটিসের বন্দোবস্ত করেছিলেন সচিনের। উইকেটের উপর কয়েন রেখে বোলারদের বলতেন, ওকে আউট করো। যে নেবে, টাকা তার। মরিয়া সচিনকেও নাকি পাল্টা বলতে শোনা যেত, “করনে দো কোশিস। আউট আমি হব না!” |
ধোনির সঙ্গে শেষ ফুটবল ম্যাচ। বুধবার ওয়াংখেড়েতে। |
দিনের পর দিন গিয়েছে, যখন বোলারদের কয়েন আর পাওয়া হয়নি। সারদাশ্রম স্কুলের প্রিন্সিপাল তো আবার বলে দিলেন যে, সচিন-কাম্বলির স্কুল ক্রিকেটে ঐতিহাসিক ৬৬৪ রানের পার্টনারশিপের সময় এক রকম বিরক্তও হয়ে পড়েছিলেন স্কুলের হেড কোচ। “আচরেকর বারবার চিৎকার করছিলেন মারা বন্ধ করে ম্যাচটা জেতার চেষ্টা করতে। না সচিন, না কাম্বলি, কেউ শোনেনি। রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক,” এ দিন হাসতে হাসতে বলছিলেন প্রিন্সিপাল কে আর শীর্শথ।
স্কুল ছুটি। সারদাশ্রম স্কুল তাই বৃহস্পতিবার থেকে ওয়াংখেড়ে অভিমুখী হচ্ছে না। কিন্তু বেশ কিছু দিন ধরেই সচিনের কিছু দুর্লভ ছবির প্রদর্শনী চলছে, আয়োজন চলছে অবসরের পর তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনার। ক্রিকেটের বাইরে ছাত্র সচিনের কিছু কথাও সারদাশ্রমে গিয়ে যা জানা গেল। যে সচিনকে কোনও দিন নাকি অভব্য আচরণের জন্য নিল ডাউন হতে হয়নি, যে সচিন স্কুলে প্রায় না এলেও পাশ করেছে সসম্মানে, যে সচিন কেঁদেকেটে একশা করেছে প্রিয় ম্যাডাম বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেবেন ভেবে, যে সচিন প্রবল অধিকারবোধে প্র্যাকটিসের পর প্রথম সরবতের গ্লাস ছিনিয়ে নিয়েছে বরাবর, যে সচিন বিখ্যাত হওয়ার পরেও বাড়িতে স্কুলের স্বর্ণজয়ন্তীর আমন্ত্রণ নিয়ে শিক্ষিকা গেলে তাঁকে নিজে ড্রাইভ করে আবার স্কুলে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন বরাবর। দাদা অজিত তেন্ডুলকর সমেত গোটা পরিবারকে বসিয়ে রেখেছে শিক্ষিকার অভ্যর্থনায়। “একটা ঘটনার কথা এখনও মনে আছে। সাত-আট বছর আগের কথা। ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম কিন্তু দারোয়ান ঢুকতে দিচ্ছিল না। রেগে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে ডেকে পাঠানোর পর সচিন যখন নেমে এল, দেখলাম মাথা নিচু করে কথা বলছে। বারবার ক্ষমা চাইছে। ক্রিকেটের ঈশ্বর হয়েও ছেলেটা বদলাল না,” বলে চলেন সারদাশ্রম স্কুলের প্রিন্সিপাল।
সব দেখলে, শুনলে একটা কথা মনে হবে। আগামী ১৮ নভেম্বরের পর ক্রিকেটার তেন্ডুলকরের বিদায়-ই শুধু ঘটতে পারে। মানুষটা বোধহয় একই রকম থেকে যাবেন। সারদাশ্রমে সবার আদরের কিশোর ‘তেন্ডলা’ যেমন ছিল! |
ছবি: উৎপল সরকার। |
|
|
|
|
|