প্রবন্ধ ১...
তাত্ত্বিক গবেষণার একটা পরিবেশ চাই

‘...how to get a Nobel Prize. I can tell you how. It is very easy. The first thing you must do is to have great teachers...Second, you must also have been blessed with great colleagues, collaborators, and fellow students...Thirdly, you must have great students.’
— পল স্যামুয়েলসন

গত মাসে ঘোষিত ২০১৩-র নোবেল পুরস্কারের মধ্যে দুটো বিষয়ের সঙ্গে কলকাতা তথা বাঙালির একটা যোগাযোগ আছে। প্রথমটার কথা বলে দিতে হবে না— পদার্থবিদ্যায় বোসন কণার অস্তিত্ব ‘আবিষ্কার’-এর জন্যে পিটার হিগস এবং ফ্রঁসোয়া এঙ্গলার্টকে দেওয়া পুরস্কার পরোক্ষ ভাবে যেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুরই নোবেল জয়। হিগস-এর অনেক আগে সত্যেন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়া উচিত ছিল কি না, তা নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। কলকাতার সঙ্গে দ্বিতীয় যোগসূত্রটি মিলটি অর্থনীতির পুরস্কারে। এ বছরের অর্থনীতিতে নোবেল প্রাপক তিন জনের অন্যতম হলেন লার্স পিটার হ্যানসেন। শেয়ার বাজারের ওঠানামা বিশ্লেষণের জন্যে নোবেল পেলেও, মূলত ওঁর আবিষ্কৃত তত্ত্বগুলির বিষয় হল সংখ্যাতত্ত্ব। ওঁর কাজের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন গবেষণা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের বেশ কিছু গবেষক গত কয়েক দশক ধরেই করে আসছেন। লক্ষ করার বিষয়, এ বারের এই দুটো পুরস্কারই আসলে বিমূর্ত তাত্ত্বিক গবেষণার জন্যে। সহজ করে বললে, মাথা খাটিয়ে কাগজে-কলমে অঙ্ক কষার জন্যেই পুরস্কার। গত বছর জেনিভার সার্ন গবেষণাগারে হিগস-বোসন আবিষ্কৃত কণার অস্তিত্ব প্রমাণের পথে একটা বিরাট অগ্রগতি ঘটে। মনে হতে পারে, সার্নেই এই কণার আবিষ্কার, এই গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবেই যেন এ বারের পুরস্কার।
বিমূর্ত তত্ত্বচর্চার ঐতিহ্য। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ও চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন।
কিন্তু হিগস (বা এঙ্গলার্ট) ঠিক ল্যাবে কাজ করে কণা আবিষ্কার করেননি, অথবা অন্য ভাবে ভাবলে, ল্যাবে কাজ করার জন্য সার্ন গবেষণাগারের কেউ কিন্তু নোবেলের দাবিদার হননি। পিটার হিগস বসে বসে অঙ্ক কষেই প্রমাণ করেছেন যে ঈশ্বর কণা নিশ্চয় আছে। নোবেল প্রাপ্তির পরে তাঁর মন্তব্য এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ: “আশা করি, বুনিয়াদি বিজ্ঞানের এই স্বীকৃতি তাত্ত্বিক গবেষণার মূল্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করবে।” (I hope this recognition of fundamental science will help raise awareness of the value of blue-sky research.) সত্যেন্দ্রনাথ বসুরও মস্তিষ্কই ছিল তাঁর গবেষণাগার। যে বিখ্যাত তিনি পেপারটা আইনস্টাইনকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, তাতে বিমূর্ত অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
একই ভাবে, লার্স পিটার হ্যানসেনও হলেন তাত্ত্বিক। ইকনোমেট্রিক থিয়োরি (তত্ত্বগত ভাবে, যা বস্তুত সংখ্যাতত্ত্ব বা স্ট্যাটিসটিক্সের সমতুল) নিয়ে তাঁর গবেষণা অর্থনীতির নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে, হয়েছেও। ভিন্ন ভিন্ন চলরাশি বা ভেরিয়েবল নিয়ে তাঁর তত্ত্ব বিশেষ করে শেয়ার বাজারের সংখ্যা বা ডেটাবেস বিশ্লেষণে কাজে লাগে। তাই তাঁকে অন্য দু’জন ফাইনান্স-তাত্ত্বিকের সঙ্গেই পুরস্কৃত করা হল। আমাদের ঘরের মহলানবীশ ও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের সংখ্যাতত্ত্বের গবেষকদের কাহিনিও এক অর্থে এই গোত্রের। মহলানবীশের থিয়োরি ভারতের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারে, এটা আঁচ করেই নেহরু তাঁকে মাথায় করে রাখেন। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট-এর প্রতিষ্ঠা হয়। মহলানবীশের ইনপুট-আউটপুট মডেল নোবেল না পেলেও নেহরুর কাজে লেগেছিল— ভারতে যোজনার ইতিহাসে এই মডেলের অবদান যুগান্তকারী। কিন্তু ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রকৃত অবদান তাত্ত্বিক গবেষণায়। সেখানে সংখ্যাতাত্ত্বিকরা তাক লাগানো তাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন। বিদেশের বহু সংখ্যাতাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ (এমনকী পরবর্তী নোবেল প্রাপকরা) এখানে একসঙ্গে কাজ করেছেন। এই শহর থেকে প্রকাশিত ‘সংখ্যা’ নামক জার্নালটির তখন বিশ্বজোড়া খ্যাতি ছিল।
জগদীশচন্দ্র বসু ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
এই তুলনাগুলো টানার পরেই একটা চিন্তা মাথায় আসে— এ হেন বিমূর্ত তাত্ত্বিক কাজ সত্যি কি আগে কলকাতায় অনেক হত, এখন আর হয় না? উদাহরণ হিসেবে শুধু পদার্থবিদ্যা বা অর্থনীতি নয়, কলা, সাহিত্য, বিজ্ঞানের যে-কোনও শাখার কথাই বলা যেতে পারে। নিন্দুকেরা অবশ্য বলবেন, দু’একটা হাতে গোনা উদাহরণ বাদ দিলে অতীতেও কলকাতা বিশ্বমানের ছিল না, আমরা তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছি। মনে পড়তে পারে সত্যজিতের ছবির উৎপল দত্ত অভিনীত আগন্তুক চরিত্রের কথা। তিনি বলেছিলেন, প্রাচীন গ্রিসে যে আড্ডা হত, তার পাশে বাঙালির আড্ডা নেহাত শিশু, আর ‘এখন তো সবই নিম্নগামী’। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক যে, গত শতকের প্রথম ভাগে সত্যই এই কলকাতাতেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হত। এখানে কাজ করেই চন্দ্রশেখর বেঙ্কট রামন পুরস্কার পেয়েছেন, জগদীশচন্দ্র বা সত্যেন্দ্রনাথ অল্পের জন্য মিস করেছেন। এ যদি সত্য বলে ধরে নিই, তা হলে প্রশ্ন হল, আগে যা হত, এখন তা হয় না কেন?
উত্তর হিসেবে অনেকেই বলবেন, এ পোড়া শহরে কেউ আর থাকতে চায়নি, ষাট-সত্তরের দশক থেকেই বিদেশে চলে যাবার হিড়িক পড়ে যায়। অমর্ত্য সেনের মতো নোবেল প্রাপকদের গবেষণা প্রায় পুরোটাই বিদেশের মাটিতে। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ নিশ্চয়ই ছিলেন, যাঁরা আশি-নব্বইয়ের দশকেও এই শহরে বসে বিশ্বমানের তাত্ত্বিক গবেষণা করেছেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অতি নগণ্য। কারণ হিসেবে অনেকে আবার বাম-জমানাকে গাল পাড়েন। গবেষকরা চলেই যেতেন, রাজনীতির সঙ্গে কার্যকারণটা নেহাতই কাকতালীয়। মেনে নিতেই হবে, আমাদের শহরে তাত্ত্বিক গবেষণার পরিবেশ আর নেই। শিক্ষাকেন্দ্রগুলির ভেতরে শুধু নয়— বাইরেও, আমাদের সমাজেও। সমস্যাটার নানান দিক। জমিদারপুত্র হিসেবে নদীবক্ষে বোটের নিরালায় কবিতা লিখে নোবেল পাওয়ার সুযোগ আমাদের ভাগ্যে আর ঘটে না। আমরা গবেষকরা আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব কষি সদানিয়ত। তাত্ত্বিক গবেষণা করে কী হবে, এই ইনসেন্টিভের প্রশ্নটা মাথায় ঘোরে। সত্যিই তো, সমাজের অন্য ক্ষেত্রের কৃতীরা যদি অর্থ, সম্মান ‘কামিয়ে’ নিতে পারেন, তা হলে আমরাই বা কঠিন অঙ্ক কষে জাগতিক জীবন নষ্ট করব কেন?
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে, একা তো কেউ পরিবেশ তৈরি করতে পারেন না। একা কাজ করে এ যুগে নোবেল পাওয়া অসম্ভব। নিজের গবেষণা অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগটুকু তো চাই। অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন তাই ১৯৭০ সালে নোবেল পুরস্কার নেওয়ার পর বলেন, এই পুরস্কার পাওয়া খুব সহজ, যদি পাশে অনেকে থাকেন। ঠিক যে-ভাবে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের গবেষকরা গবেষণা করতেন। প্রসঙ্গত, এই ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেই বিদেশে গবেষণা করতে যাবার সুযোগ আমার হয়েছিল। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বেলজিয়ামের কোর নামের কেন্দ্রটিতে গিয়েছিলাম। কোর-এর প্রাণপুরুষ হলেন বিখ্যাত এক বেলজিয়ান অর্থনীতিবিদ, জাক দ্রেজ— যাঁর পুত্র জঁ’কে আমরা সকলেই এখন বিলক্ষণ চিনি, অমর্ত্য সেনের সহকর্মী ও সহ-লেখক হিসেবে। আমাদের দেশে অবশ্য পিতা দ্রেজের পরিচিতি পুত্র দ্রেজের খ্যাতির ধারেকাছেও নয়। পিতার বিস্তৃত কর্মপরিধির মধ্যে গবেষণা মূলত বাজার অর্থনীতির জেনারেল ইক্যুইলিব্রিয়াম তত্ত্ব নিয়েই। তবে তিনি যে জাগতিক ব্যাপারে নিরুৎসাহ ছিলেন, তেমনটা বলা যাবে না। ইউরোপের সব দেশে একটাই মুদ্রা (ইউরো) চালু হবার অনেক আগেই জাক দ্রেজের গবেষণার ফল হিসেবে ‘ইউরো’ চেকবই-এর ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ইউরোপের নানা দেশের লোকেরা একটাই চেকবই রাখবেন। কিন্তু, বইয়ের বিভিন্ন পাতার চেকগুলো, তখনকার যে-কোনও ইউরোপের দেশের মুদ্রাতে (ফ্ঁরা, মার্ক, লিরা ইত্যাদি) লেখা যাবে। যিনি চেকটা পাবেন, তিনি যে দেশের মুদ্রার চেক, সেখানের ব্যাঙ্কে জমা দিতে পারবেন। ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রার চেকের হিসেবনিকেশের তত্ত্ব পিতা দ্রেজের মস্তিষ্কপ্রসূত।
এ হেন জাক দ্রেজ বেলজিয়ান সরকারের অর্থানুকূল্যে কোর নামক গবেষণাকেন্দ্রটি গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য, গাণিতিক অর্থনীতির বিমূর্ত গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে চলা। প্ল্যান হল, এই কেন্দ্রে শুধুই স্নাতকোত্তর স্তরের পড়া চলবে। পড়তে, পড়াতে ও গবেষণা করতে সারা পৃথিবীর গবেষকরা বেলজিয়ামে আসবেন। গাণিতিক অর্থনীতিতে কোর ক্রমশ বিশ্বের অন্যতম সেরা গবেষণা কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে জড়ো হয়েছেন বিভিন্ন দেশের অজস্র নামজাদা গবেষক। জাক দ্রেজ বেলজিয়ামের মতো ছোট দেশকে অর্থনীতির জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছেন। ঠিক পল স্যামুয়েলসন নোবেল পাওয়ার শর্ত হিসেবে যা চেয়েছিলেন।

পুনশ্চ: পল স্যামুয়েলসনের মতে নোবেল পাওয়ার শেষ শর্তটা আমি উল্লেখ করিনি। সেটা হল: ‘লাক’। মানে, কপাল।

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.