মহাকরণের ঠিক পিছনে লায়ন্স রেঞ্জের পাঁচতলা পেল্লায় বাড়ি। তাতে ৭০০ স্কোয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ১০০ টাকা। গড়িয়াহাট রোডে ৭৫০ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের ভাড়া আরও কম, মাত্র ৩৯ টাকা। সিআইটি রোডে পোদ্দার কোর্টের উল্টো দিকে প্রমাণ সাইজের ফ্ল্যাটের ভাড়া ২৫০ টাকা। বাগবাজারে ১ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের জন্য ভাড়াটেকে দিতে হয় মাত্র ৩৫০ টাকা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার ভাড়ার হার নয়। ২০১৩ সালে শহরে এই ভাড়া দিয়েই বাস করছে বহু পরিবার। ভাড়া বাবদ যে টাকা মিলছে, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও পুরসভার কর দিতে গিয়ে ঢের বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে বাড়ির মালিকদের। যাঁরা সেই খরচ জোগাতে পারছেন না, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙেচুরে পড়ছে সে সব বাড়ি। কোথাও বা প্রাণ হাতে নিয়ে থাকছেন বাসিন্দারা। এই ডামাডোলে গায়ের জোরে পুরনো বাড়ি ও ফ্ল্যাটের দখল নিতে নেমে পড়ছে এক শ্রেণির ডেভেলপার।
বাড়ির মালিকদের একাংশের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকা বহু পরিবারই এখন শহরে বিভিন্ন এলাকায় নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন। সেখানে পরিবারের অনেকে চলেও গিয়েছেন। কিন্তু নামমাত্র ভাড়ার পুরনো ফ্ল্যাটটি কেউই ছাড়ছেন না।
৮ লায়ন্স রেঞ্জের বাড়িটি বর্ধমানের মহারাজা উদয়চাঁদ মহতাবের থেকে লিজ নিয়েছিলেন প্রমথনাথ রায়। তাঁর নাতি বেণীমাধব রায় বলেন, “১৯৭২ সালের আগে শেষ বার কিছু ভাড়াটে সামান্য ভাড়া বাড়িয়েছেন। একতলায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বছর কয়েক হল ভাড়ার টাকাই বন্ধ করে দিয়েছে।” বাগবাজারের লক্ষ্মী দত্ত লেনের ১ হাজার বর্গফুটের ওই ফ্ল্যাটের মালিক দীপক মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “পুরনো ভাড়াটেরা এখন কার্যত বাড়ির মালিক। আমাদের আইনই এমন যে তাঁদের কাছ থেকে কোনও ভাবেই বর্তমান হারে ভাড়া আদায় করা যাবে না। আবার তাঁদের উচ্ছেদও করা যাবে না।”
ভাড়া বাড়ানোর আইনি প্রক্রিয়াটি যে অত্যন্ত জটিল, তা মানছেন বাম সরকারের ভূমিমন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাও। তাঁর আমলেই সরকার এই আইন সরলীকরণের চেষ্টা
চালিয়েছিল। রেজ্জাক বলেন, “অনেক বাধা সত্ত্বেও আইনি সংশোধনের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু এত মামলা মোকদ্দমা হয় যে আমাদের বিশেষ কিছুই করার ছিল না।” তাঁর মতে, রেন্ট কন্ট্রোলগুলোকে সক্রিয় করতে যে সংখ্যক কর্মী দরকার, তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। রেজ্জাক বলেন, “সমস্যা দেখেও তাই আমাদের চোখ বন্ধ করে থাকতে হয়েছে।” অবস্থা বদলায়নি তৃণমূল সরকারের আমলেও। ক্যালকাটা হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক সুকুমার রক্ষিত বলেন, “আমরা গত দশ বছরে অন্তত তিরিশ বার মন্ত্রী-সচিবদের কাছে এ ব্যাপারে আর্জি জানিয়েছি। নতুন সরকার আসার পরেও এই সমস্যার সমাধানের জন্য লিখিত ভাবে আবেদন করেছি। কিন্তু সরকার আমাদের সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, চিঠির উত্তরও দেয়নি।”
মালিক-ভাড়াটে কাজিয়ার সময়ে ভাড়ার টাকা দেওয়ার জন্য সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের অধীনে ‘রেন্ট কন্ট্রোল’ বিভাগ রয়েছে। রাজ্যের ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের বিবাদের ফলে ভাড়ার টাকা জমা পড়ে সরকারের রেন্ট কন্ট্রোল বিভাগে। ওই তহবিলে জমা পড়ছে প্রচুর টাকা। বর্তমানে এই তহবিলের পরিমাণ প্রায় পৌনে দুশো কোটি টাকা।” কিন্তু গোটা কলকাতার জন্য ওই পদে রয়েছেন মাত্র এক জন। সেখান থেকে ভাড়ার টাকা আদায় করতে জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে যায়। গড়িয়াহাটের বাড়ির মালিক অসিতকুমার কুণ্ডু চৌধুরী বলেন, “এমনও হয়েছে, রেন্ট কন্ট্রোল থেকে এক মাসের ভাড়ার টাকা আদায় করতে কেটে গিয়েছে আট বছরেরও বেশি।” বাড়ির মালিকদের একটি সংগঠনের কর্তা অমর মিত্রর অভিযোগ, “রেন্ট কন্ট্রোল থেকে টাকা আসে যৎসামান্য।”
এই পরিস্থিতি থেকে নিষ্কৃতি পেতে গৃহমালিকদের কেউ কেউ বাড়ি জলের দরে বিক্রি করে দিচ্ছেন ভাড়াটে-সহ এই বাড়ি কেনা-বেচায় সিদ্ধহস্ত এক শ্রেণির ডেভেলপারদের। পুলিশ সূত্রের খবর, এই ব্যবসায়ীরা জানেন, আইনের তোয়াক্কা না করে কী কায়দায় পুলিশ, রাজনৈতিক নেতাদের হাতে রেখে ভাড়াটে উচ্ছেদ করতে হয়। ভাড়াটে উচ্ছেদের পরে সেখানে তৈরি হচ্ছে ফ্ল্যাটবাড়ি। কিন্তু সে বাবদ লাভের প্রায় পুরোটাই পকেটে পুরছে ডেভেলপার, নেতা, পুলিশ, মস্তান বা বাউন্সার চক্র। বাড়ির প্রকৃত মালিক কার্যত কিছুই পাচ্ছেন না। উমেশ ব্যানার্জি স্ট্রিটের তিনতলা বাড়ির মালিক শিবানী রক্ষিতের বক্তব্য, “এ ছাড়া করারই বা কী আছে? এ রকম জায়গায় একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া পাচ্ছি ৪০ টাকা। আইনের পথে গিয়ে যে লাভ নেই, তা বাড়ির মালিকেরা ভালই জানেন।”
|