মাতৃদুগ্ধের উপকারিতা নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ইউনিসেফের তরফে মাঝেমধ্যেই প্রচার চালানো হয়। কিন্তু সচেতনতা বাড়াতে মায়েদের রীতিমতো ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনা, তা-ও সরকারি স্তরে! এমনটাই ঘটেছে ব্রিটেনে।
ইয়র্কশায়ার আর ডার্বিশায়ারে সদ্য মা হয়েছেন এমন ১৩০ জনকে নিয়ে একটি সমীক্ষা শুরু হয়েছে মঙ্গলবার থেকে। শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়াতে রাজি আছেন কি না তা জানিয়ে প্রথমে মায়েদের একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে। এর পর শিশুর বয়স পর্যায়ক্রমে দু’দিন, ১০ দিন এবং ৬ সপ্তাহ হলে মায়েদের কাছে জানতে চাওয়া হবে, তাঁরা তখনও তাঁদের বাচ্চাদের মাতৃদুগ্ধ খাওয়াতে রাজি আছেন কি না। যদি রাজি থাকেন, তা হলে তিন বার ৪০ পাউন্ড করে মোট ১২০ পাউন্ডের (১২ হাজার ১৫০ টাকা) ভাউচার দেওয়া হবে। ওই ভাউচারের সাহায্যে মায়েরা দেশের নামকরা স্টোর (তার মধ্যে বেশ কয়েকটি ফ্যাশন স্টোর এবং পানীয়ের দোকানও রয়েছে) থেকে তাঁদের পছন্দের জিনিস কিনতে পারবেন। শিশুদের ছ’মাস বয়স হলে যদি মায়েরা তখনও শিশুদের স্তন্যপান করান তা হলে পুরস্কার স্বরূপ আরও ৮০ পাউন্ডের (৮ হাজার ১০০ টাকা) ভাউচার দেওয়া হবে।
দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা (এনএইচএস)-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছে গোটা ব্রিটেনেই শিশুদের মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর হার খুবই কম। মাত্র ৩৪%। দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে এই হার আরও কম। সমীক্ষায় আরও দেখা গিয়েছে, দেশের যে অঞ্চলগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে সেখানেই শিশুদের টিনবন্দি খাবার খাওয়ানোর চল বেশি। বিভিন্ন এলাকায় কয়েক প্রজন্ম ধরেই এই ট্যাডিশন চলছে। ফলে সেখানকার মায়েদের ধারণাই নেই, কী ভাবে স্তন্যপান করাতে হয়। অনেকে আবার ভাবেন, স্তন্যপান করালে শরীরের গঠন খারাপ হয়ে যাবে।
সমীক্ষা থেকে পাওয়া এই তথ্যে রীতিমতো আশঙ্কিত দেশের চিকিৎসকমহল বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় এই প্রকল্প চালু করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার কিছুটা চেষ্টা হল বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। গবেষক দলের অন্যতম ক্লেয়ার রেলটন জানিয়েছেন, এই ভাউচার ব্যবস্থায় উৎসাহ পেয়ে স্তন্যপানের হার বাড়লে ক্যামেরন সরকার সামনের বছর থেকে জাতীয় স্তরে সমীক্ষা শুরু করবে বলে সায় দিয়েছে।
কিন্তু এই ভাউচার ব্যবস্থা নিয়েই আপত্তি তুলেছেন অনেকে। ভাউচারের সাহায্যে মায়েরা সিগারেট আর মদ কিনবেন বলে তাঁদের আশঙ্কা। তাই একে ঘুষ বলতেই পছন্দ করছেন তাঁরা। আবার অনেকের মতে, মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোতে রাজি আছেন কি না ফর্মে একবার তা লিখে দিলেই মায়ের উপর নজরদারির আর কোনও উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে টাকা নিয়েও যদি তিনি স্তন্যপান না করান, সেটা আটকানো সম্ভব নয়।
আশঙ্কার কথা মানছেন রেলটনও। তবে তিনি জানিয়েছেন, ভাউচার ব্যবস্থার কী প্রভাব মায়েদের উপর পড়ছে সেটা পরীক্ষা করতে সাহায্য নেওয়া হবে মনোবিদদেরও।
কনজারভেটিভ এমপি শার্লট লেসলির মতে, “এটা সরকারি অর্থের অপচয়। মায়েরা তাঁর সন্তানকে স্তন্যপান করাতে চান না কেন তার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। শুধু মাত্র ঘুষ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।” একই মত জ্যানেট ফাইলেরও। পেশাদার নীতি উপদেষ্টা জ্যানেট বললেন, “স্তন্যপান করালে বাচ্চার স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে এটা জানলে মা নিজে থেকেই স্তন্যপান করাবেন। তার জন্য লাগাতার প্রচারের মাধ্যমে সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। টাকার টোপ নয়।”
যদিও এনএইচএস-এর তরফে জানানো হয়েছে, প্রতি বছর শিশুদের চিকিৎসা খাতেই প্রচুর অর্থব্যয় হয় সরকারের। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, জন্মের ছ’মাস পর্যন্ত স্তন্যপান করালে শিশুদের রোগবালাইয়ের হার কমে যায়। শুধু তা-ই নয়, নিয়মিত স্তন্যপান করলে পরবর্তীকালে শিশুদের স্থূলত্ব বা ডায়াবেটিসের হারও অনেক কমে যায়। তাই উপহার হিসেবে ভাউচার দেওয়ার পরিবর্তে যদি স্তন্যপানের হার বাড়ানো যায়, প্রতি বছর সরকারের অন্তত ৪ কোটি পাউন্ড (প্রায় ৪০৫ কোটি টাকা) খরচ বাঁচবে বলেই জানিয়েছে এনএইচএস।
বাচ্চার স্বাস্থ্য না অর্থ, এখন কোনটা মায়েদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, তার দিকেই তাকিয়ে গোটা দেশ। |