শিশুর জন্মের পরে কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ নিয়ে জোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগেই। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে কোনও বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে এক বার গেলেই ফোন আসতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহিলা বা তাঁর বাড়ির লোকের কাছে। কোনও একটি সংস্থা নয়, একাধিক সংস্থার ফোন। প্রত্যেকেরই দাবি, তাদের ‘অফার’টাই সেরা! কর্ড ব্লাড সংরক্ষণ ও তার সুফল নিয়ে এমন হাজারো আশ্বাসের কোনটিতে ভরসা রাখা যায়, সে নিয়ে দম্পতিরাও বিভ্রান্ত। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যে প্রথম সরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কটি চালু হতে চলেছে কলকাতায়। স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, রাজ্যে স্টেম সেল প্রতিস্থাপনের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্ড ব্লাড নিয়ে বাণিজ্যে খানিকটা রাশ টানতেই সরকারের এই সিদ্ধান্ত।
তবে সরকারি ওই ব্যাঙ্কে আপাতত আলাদা ভাবে কেউ নিজের সন্তানের কর্ড ব্লাড রাখতে পারবেন না। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের প্রসূতি বিভাগ থেকে কর্ড ব্লাড সংগ্রহ করে রাখা হবে। যাঁদের চিকিৎসায় স্টেম সেল দরকার, তাঁরা ওই কর্ড ব্লাড থেকে পাওয়া স্টেম সেল ব্যবহার করতে পারবেন।
রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই স্টেম সেলের জন্য হাজার হাজার টাকা খরচের প্রয়োজন পড়বে না। দরিদ্র রোগীদের জন্য এই ব্যাঙ্ক থেকে নিখরচয়া স্টেম সেল পাওয়া যাবে। এত দিন পর্যন্ত যাঁদের টাকা রয়েছে, শুধু তাঁরাই কর্ড ব্লাড সংরক্ষিত রাখতে পারতেন। এ বারে বড়লোকের একচেটিয়া অধিকারটা বন্ধ করা হচ্ছে।”
ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া এবং রক্তের বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় একেবারে চূড়ান্ত ধাপ স্টেম সেল প্রতিস্থাপন। প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতার রক্তের হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ) মেলা খুব জরুরি। শিশুর জন্মের পরে যে আম্বিলিক্যাল কর্ডটি বিচ্ছিন্ন করা হয়, সেটি স্টেম সেলের অন্যতম উৎস। রক্তের ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া এবং রক্তের বিভিন্ন অসুখের চিকিৎসায় বিশ্ব জুড়েই স্টেম সেলের ব্যবহার চলছে। স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এও স্টেম সেল নিয়ে গবেষণা চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং এই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মূলত তাঁর উদ্যোগেই কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্কের কাজ গতি পেয়েছে।
এই প্রকল্পে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার জন্য ৯০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কবে নাগাদ ব্যাঙ্কটি চালু হবে? স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, কাজে যাতে কোনও গাফিলতি না হয় তাই দু’মাস অন্তর ট্রপিক্যালের অধিকর্তাকে কাজের রিপোর্ট জমা দিতে হবে রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার কাছে।
নবজাতকের শরীর থেকে সংগৃহীত স্টেম সেল ভবিষ্যতে কী কাজে আসতে পারে? বিভিন্ন বেসরকারি স্টেম সেল ব্যাঙ্কের কর্তাদের দাবি, এই মুহূর্তে থ্যালাসেমিয়া এবং লিউকেমিয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্টেম সেল ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবিটিস, অ্যালজাইমার্স-সহ বিভিন্ন দুরারোগ্য অসুখের চিকিৎসা, এমনকী দুর্ঘটনায় কোনও অঙ্গ বাদ গেলে তা-ও তৈরি করা যেতে পারে স্টেম সেলের সাহায্যে। যাঁর স্টেম সেল, তাঁর নিজের এবং ভাই-বোনের ক্ষেত্রে সেটি তো কাজে লাগেই, পরিবারের অন্য সদস্যদের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ভাল ফল দিতে পারে এটি।
এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি সংস্থা মাতৃ জঠর ও শিশুর নাভির সঙ্গে যুক্ত নাড়ির রক্ত থেকে স্টেম সেল সঞ্চয়ের কাজ করছে। এই উদ্যোগকে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা প্রাথমিক ভাবে স্বাগত জানালেও প্রশ্ন তুলেছেন, যে পরিবারে জিনগত সমস্যা নেই, সেখানে স্টেম সেল সংরক্ষণ করে কী লাভ? এখনও পর্যন্ত এ দেশে গবেষণার যত দূর অগ্রগতি, তাতে কি এখনই ভবিষ্যতের কোনও রোগ বা দুর্ঘটনার কথা ভেবে স্টেম সেল সংরক্ষণ করে রাখা উচিত, নাকি এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক স্বার্থটাই বড় হয়ে উঠছে? সরকারি কর্ড ব্লাড ব্যাঙ্ক চালু হয়ে গেলে অবশ্য এই ধরনের প্রশ্নের আর অবকাশ থাকবে না।
ভবিষ্যতে কি বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে যৌথ ভাবে কোনও প্রকল্প শুরু করার কথা ভাবছে স্বাস্থ্য দফতর? দফতরের এক কর্তা বলেন, “এখনও তেমন পরিকল্পনা নেই। ভবিষ্যতে সংস্থাগুলির তরফে প্রস্তাব এলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রেও বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সরকারের শর্ত মেনে চলতে হবে। কারণ, এই পরিষেবা যাতে কোনও ভাবেই গরিব মানুষের নাগালের বাইরে না যায়, সে ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী বদ্ধপরিকর।” |