দু’পাশে দু’জন যাত্রী নিয়ে অটো চালাচ্ছেন চালক। অটো-নিয়ন্ত্রণ আইনের বিরুদ্ধ হলেও শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন রুটে এই দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। যাত্রীদের একাংশও সময় বাঁচাতে গিয়ে এ ধরনের আইনবিরুদ্ধ কাজে চালককে সহযোগিতা করেন।
এক সন্ধ্যার ঘটনা, চালকের পাশে দু’জন যাত্রী নিয়ে চলছিল অটো। সল্টলেক থেকে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের কাছে আসতেই আচমকা ডান দিকের যাত্রীর কানে ফিসফিস করে চালক জানালেন, “একটু নেমে রাস্তার উল্টো দিকে গিয়ে দাঁড়ান। রাস্তা পেরিয়ে তুলে নিচ্ছি। বাধ্য ছাত্রের মতো ওই যাত্রীও নেমে গেলেন। এবং রাস্তার উল্টো দিক থেকে ফের চালকের পাশে চেপে বসলেন। যদিও অটো-নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী চালকের পাশে এক জনই বসতে পারেন। কিন্তু সে দিন রাস্তায় টহল দিচ্ছিলেন কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। তাই চালক এক জন যাত্রীকে নামিয়ে, সার্জেন্টের চোখ এড়িয়ে, ফের তুলে নিলেন। শুধু সল্টলেক নয়। শহরতলির বিভিন্ন রুটে এ ভাবেই রোজ নিয়ম ভেঙে পুলিশের চোখের সামনেই চলছে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ।
তবে অটোর ক্ষেত্রে নিয়মের ফস্কা গেরোর উদাহরণ অসংখ্য। নিত্যযাত্রীদের দাবি, রাত হলেই উল্টোডাঙা থেকে ডানলপ পর্যন্ত অটো মেলে। অথচ ওই ‘রুটে’র কোনও অটোর গায়ে রুট লেখা থাকে না। ভাড়া ২৫-৩০ টাকা। যদিও আঞ্চলিক পরিবহণ দফতর থেকে এমন কোনও রুটের সরকারি অস্তিত্ব মেলেনি। তা সত্ত্বেও ওই পথে রোজ চলছে অটো।
অটোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বিধি ঠিক কী? উত্তর কার্যত গোলকধাঁধা। যেমন, দক্ষিণ কলকাতায় পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত যদি অটোর ভাড়া ছ’টাকা হয়, উত্তর কলকাতা বা সল্টলেকে সেই ভাড়া দশ থেকে বারো টাকা। এ ছাড়াও নির্ধারিত রুট ভেঙে অন্য পথে অটো চলাচল, রুট ছাড়িয়ে আরও দূর পর্যন্ত অটো চলাচলের অভিযোগও বিস্তর।
ফুলবাগান থেকে গিরিশ পার্কের অটোয় উঠেছিলেন বেলেঘাটার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত দেবাশিস বসু। তিনি জানান, গাড়ি কিছু দূর এগোতেই চালক বলেন, “মানিকতলা পর্যন্ত যাবে। কিন্তু পুরো ভাড়া দিতে হবে।” অটোচালকের দিকে ১০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে দেবাশিসবাবু প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পুরো ভাড়া দেব কেন?’ টাকাটা নিয়ে কোনও উত্তর না দিয়ে অটোচালক চলে গিয়েছিলেন। কিছুটা সময় উদ্দেশ্যহীন গালিগালাজ করে ফের আরেকটি অটোর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন দেবাশিসবাবু। শেষে অটো না পেয়ে সে দিন তাঁকে ট্যাক্সিতে ফিরতে হয়েছিল।
ভাড়া নিয়েও রয়েছে নানা তারতম্য। দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাট থেকে রাসবিহারি অ্যাভিনিউ পর্যন্ত ২ কিলোমিটারের ভাড়া ৬ টাকা। আবার গড়িয়াহাট থেকে বাইপাসের রুবি মোড় পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার যেতেও ভাড়া লাগে ৬ টাকা।
অটোর ক্ষেত্রে বেনিয়মের এমন অজস্র উদাহরণ প্রতি দিন কলকাতা-সহ শহরতলিতে মিলছে। খোদ পরিবহণমন্ত্রী কিছু দিন আগেই জানিয়েছিলেন, রাজ্যে হাজার-হাজার অটোর বৈধ কাগজই নেই। পরিবহণ দফতরের এক কর্তা বললেন, “শহর ও শহরতলি বিভিন্ন এলাকায় কত অটো চলে তার পর্যাপ্ত হিসেব পরিবহণ দফতরের কাছে নেই।”
কিন্তু অটো-নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না কেন?
প্রশাসনের দাবি, বাস ও ট্যাক্সির ভাড়া সরাসরি রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অটোর ভাড়া নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সরকারের হাতে নেই। পরিবহণ দফতর ও পুলিশ রুট নির্ধারণ ও পারমিট দেওয়ার কাজ করে। ভাড়া নির্ধারণ করে রাজনৈতিক মদতপুষ্ট শ্রমিক সংগঠনগুলি।
আইএনটিটিইউসি’র নেতা শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “অভিযোগ পেলে নিদিষ্ট রুটের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। তার পরে পুলিশকে জানানো হয়। আমরা সব সময়েই ভাড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।”
সিটুর রাজ্যস্তরের নেতা অনাদি সাহু বলেন, “শহর ও শহরতলি বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ সিটু পরিচালিত অটো সংগঠনগুলি শাসক দল জোর করে দখল করে নিয়েছে। এখন তারাই ভাড়া-সহ সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছে। পরিবহণমন্ত্রীকে জানিয়েছি। তবে যে অটো সংগঠনগুলি আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে আমরা ভাড়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করি।”
তবে ভাড়ার বিষয়ে সব রুটের অটো চালকদের বক্তব্য প্রায় একই রকম দিনের পর দিন জ্বালানি খরচ বাড়ছে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে সরকার থেকে শাসক দল কারও কোনও হেলদোল নেই। লোকসান করে তো অটো চালানো যায় না। অটোচালকদের একাংশের সংযোজন, কখনই জবরদস্তি করে ভাড়া নেওয়া হয় না। শুধু উৎসবের মরসুমে কয়েক টাকা বেশি নেওয়া হয়। বেশ কিছুদিন আগে, রাজ্য সরকার নির্দেশ দিয়েছিল যে, যাত্রী-স্বার্থে প্রতিটি অটোতে ভাড়ার তালিকা লাগাতে হবে। কিছু অংশে সে কাজ হলেও প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হয়নি। যাত্রীদের অভিযোগ, যখন-তখন ভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। একই শহরে অটোর ভাড়ার মধ্যে কোনও সমতা নেই।
শহর ও শহরতলিতে ভাড়া নিয়ে অটোচালকদের জুলুমের বিষয়ে ওয়াকিবহাল পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। তিনি বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। শীঘ্রই পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। তার পরে লাগাতার অভিযান শুরু হবে।” সন্ধ্যার পর অটোর দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারি ও বেসরকারি বাস চালানোর বিষয়টি নিয়েও রাজ্য সরকার পরিকল্পনা করছে বলে মন্ত্রী জানান। |